না ফেরার দেশে বিশ্বের সবচেয়ে ‘দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুজিকা

বিশ্বজুড়ে বামপন্থীদের কাছে এক কিংবদন্তি ও গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে ‘পেপে’ মুজিকা মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৯ বছর। খাদ্যনালির ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ এক বছরের লড়াইয়ের পর চলতি মে মাসের শুরুতে তাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল।

উরুগুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইয়ামান্দু ওরসি এক শোকবার্তায় বলেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা আমাদের কমরেড পেপে মুজিকার প্রয়াণের খবর জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক কর্মী, পথপ্রদর্শক এবং নেতা। প্রিয় বন্ধু, আপনাকে আমরা খুব মিস করব।’

বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস তার ‘অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা’কে স্মরণ করেন। ব্রাজিল সরকার তাকে ‘আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে শোক প্রকাশ করেছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, ‘মুজিকা একটি উন্নত বিশ্বের জন্য বেঁচে ছিলেন।’ গুয়াতেমালার বার্নার্ডো আরেভালো তাকে ‘নম্রতা এবং মহত্ত্বের উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার শোকবার্তায়।

২০১০-১৫ সালের মেয়াদে মুজিকা তার বেতনের বেশির ভাগ অংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি স্যান্ডেল পরে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে তার ছোট্ট খামারে বসবাস করতেন। বাড়িতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল ১৯৮৭ সালের একটি ফক্সওয়াগন বিটল গাড়ি।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন, ভোগবাদের সমালোচনা করতেন এবং সামাজিক সংস্কার নিয়ে কাজ করতেন। এতে মুজিকা লাতিন আমেরিকা ও এর বাইরেও সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

মাত্র ৩৪ লাখ বাসিন্দার দেশ উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা ছিল কল্পনাতীত।

একবার তিনি বলেছিলেন, রাজনীতির পাশাপাশি বই ও জমিতে কাজ করতে ভালো লাগত তার। কাজের প্রতি এই আবেগ তিনি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। মুজিকা দেশটির রাজধানী মন্টেভিডিওতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হন।

তরুণ বয়সে মুজিকা উরুগুয়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক শক্তি ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ছিলেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে তিনি টুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলএন-টি) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এটি একটি বামপন্থী শহুরে গেরিলা গ্রুপ ছিল, যারা হামলা, অপহরণ ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত। যদিও মুজিকা সবসময় বলতেন, তিনি কখনো কোনো হত্যা করেননি।

কিউবার বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে এমএলএন-টি উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে গোপনে প্রতিরোধ প্রচারণা শুরু করে। যদিও তৎকালীন সরকার সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ছিল, তবুও বামপন্থীরা তাকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করতেন।

এই সময় মুজিকাকে চারবার আটক করা হয়। এর মধ্যে একবার, ১৯৭০ সালে তাকে ছয়বার গুলি করা হয় এবং সেবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বেঁচে ফেরেন।

তিনি দু'বার কারাগার থেকে পালান। একবার ১০৫ এমএলএন-টি বন্দীর সঙ্গে একটি টানেলের মধ্য দিয়ে পালান। এটি ছিল উরুগুয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পালানোর ঘটনা।

১৯৭৩ সালে উরুগুয়ের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটালে তাকে ‘নয়জন জিম্মি’র একটি দলে রাখা হয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে মুজিকা ১৪ বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন। এ সময় তিনি নির্যাতনের শিকার হন। বেশির ভাগ সময় তাকে একা রাখা হতো।

১৯৮৫ সালে উরুগুয়ে আবার গণতন্ত্রে ফিরলে তিনি মুক্তি পান।

২০২০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তার সেই ‘চাকরা’ বা ক্ষুদ্র খামার বামপন্থী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং অনুরাগীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। মুজিকা ভোগবাদের সংস্কৃতি এবং এর ফলে পৃথিবীর পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তার কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমরা আত্মঘাতী সমাজ তৈরি করেছি। আপনার কাজ করার সময় আছে, কিন্তু বাঁচার সময় নেই।’

২০২৪ সালের মে মাসে মুজিকার ক্যানসার ধরা পড়ে। তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি এখনো জীবিত। গেরিলা যোদ্ধা থাকার সময় লুসিয়ার সঙ্গে মুজিকার পরিচয় হয়। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। মৃত্যুর আগে তিনি সেই খামারে, তার পোষা কুকুরের পাশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সামরিক ট্যাঙ্কের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলল চিন Jul 02, 2025
img
বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ, জাপানকে দোষারোপ ট্রাম্পের Jul 02, 2025
img
ঢাকায় আংশিক মেঘলা আকাশ, স্বস্তির আশা Jul 02, 2025
img
পদ্মার পানি বাড়ছে! Jul 02, 2025
img
রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করলেই ৫০০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রে Jul 02, 2025
img
আহত হয়েও শুটিং শেষ করলেন আদা শর্মা Jul 02, 2025
img
সাত অঞ্চলে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতির ঝড়ের আভাস Jul 02, 2025
img
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যুর মিছিল, নিহত ১০৯ Jul 02, 2025
img
ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী সাফল্য! Jul 02, 2025
img
দুই ঘণ্টার চেষ্টায় টিকাটুলির কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে Jul 02, 2025
img
১৯৭৩ সালের পর ডলারের সর্বাধিক পতন, সংকটে যুক্তরাষ্ট্র Jul 02, 2025
img
ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে ১৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো ভারত Jul 02, 2025
img
জবি শিক্ষকের নামে মিথ্যা প্রচারের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ Jul 02, 2025
দাঁড়িয়ে থাকা বোয়িং বিমানে আঘাত করল লাগেজ ট্রলি Jul 02, 2025
img
টিকাটুলিতে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট Jul 02, 2025
img
দাম কমলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের Jul 02, 2025
প্রতিটি শহীদ পরিবারের সম্মানজনক পুনর্বাসনের আশাবাদ খালেদা জিয়ার Jul 02, 2025
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভেবে দেখার অনুরোধ তারেক রহমানের Jul 02, 2025
img
'আমি ছাড়া কে আছে আমার' Jul 02, 2025
img
৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির শর্তে রাজি ইসরায়েল Jul 02, 2025