আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সব ধরনের প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেছেন, ‘শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর ও আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) তাঁর কথায় শক্ত আছেন বলে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এমন একটি নির্বাচন হবে যেটা ইতিহাস সৃষ্টি করবে এবং প্রত্যেকটি মানুষ ভোট দিয়ে হাসি মুখে বের হবে।আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবেন।’
রবিবার (২৫ মে) সকাল সাড়ে ১১টায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় স্থানীয় ‘দখিনা দাওয়া’ হলরুমে উপজেলা জামায়াত আয়োজিত চা শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আমরা মনে করি নির্বাচনের মুখ্য সময় দুইটি। একটা হলো রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।
যদি রমজানের আগে কোনো কাজ একান্ত বাকি থেকে যায় সর্বোচ্চ এপ্রিল পার হওয়া উচিত নয়। কারণ এরপর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিস্থিতি ঠিক থাকবে না।’
মানবিক করিডর ও বন্দর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘করিডর ও বন্দর বিষয়ে সরকারকে আমাদের অবস্থান জানানো হয়েছে, আমরা নো বলেছি। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে আমরা কোনো কিছুতে হ্যাঁ বলব না।
দেশের স্বার্থ যেখানে বিক্রিত হবে সেখানে নো। নির্বাচিত সরকারের যদি এ ধরনের কোনো ইস্যু থাকে, তাহলে পার্লামেন্ট সেটি সিদ্ধান্ত নেবে। এখন যদি সিদ্ধান্ত নিতে চান, তাহলে পার্লামেন্ট হবে সকল রাজনৈতিক দল। তাদের নিয়ে বসতে হবে, তাদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে, তারপর সমষ্টিগতভাবে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটাই বাস্তবায়িত হবে।’
মতবিনিময় সভায় চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই দেশে আসমানের নিচে জমিনের ওপরে যত নাগরিক থাকবে, তারা সমান মর্যাদা, সমান ইজ্জত, সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে।চা-বাগানের শ্রমিকদের মালিকদের পক্ষ থেকে শর্ত জুড়ে দেবে কেন। চা শ্রমিকদের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারে যারা যায় তারা কি শ্রমিকদের ভোট নেন না? যদি নিয়ে থাকেন তাদেরকেও অন্যান্য নাগরিকদের মতো সমানভাবে নিতে হবে। বাগানগুলোতে অসংখ্য প্রতিভা লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই যে দিন আনে দিন খায়, মা-বাপের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ছোট সন্তানদের পড়াবে কিভাবে, তার সন্তান অসুস্থ হলে ভালো চিকিৎসা দেবে কিভাবে। তারা এখনও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের যদি এই দেশের জনগণ আল্লাহর ইচ্ছায় দায়িত্ব দেয় তাহলে আমরা তাদের সম্মানের আসনে বসাব এবং তাদের সন্তানদের প্রতিভার বিকাশে আমরা পাশে দাঁড়াব।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাগান মালিকরা কেন শ্রমিকদের উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করেন না। দুনিয়াবি আধুনিক হচ্ছে, আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ করে বাগানেও পরিবর্তন আনা সম্ভব। কাদের দিয়ে সম্ভব যাদের জন্ম বাগানে হয়েছে, এই বাগানকে যারা ভালোবাসে বুকে যারা ধারণ করে তাদেরকেই যদি শিক্ষিত করে তাদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়া হয় তাহলে কষ্ট হবে কম, উৎপাদন হবে বেশি, মালিকও খুশি এবং শ্রমিকও খুশি। এরজন্য প্রয়োজন শিক্ষাটাকে তাদের সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তখন তারা কারো দয়ার দিকে তাকাবে না, তাদের যোগ্যতার বলে তারা পরিবারকে গড়ে তুলবে, সমাজকে তারা উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় সেই সমাজটাই দেখতে চাই, ধর্মের ভিত্তিতে আমরা কোন ব্যবধান করতে চাই না। আমরা এজন্য একটা অহিংস ও একটা বন্ধুপ্রতিম সমাজ গড়তে চাই। হিংসা নয়, জাত-পাতের উচ্চতা-নিচুতায় নয়, সমস্ত মানুষ উচ্চ।’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সমাজের এই তথাকথিত শিক্ষিত বন্ধুরা সমাজের রক্ত চুষে নিয়ে নিজের পকেটে লুকায়, আমরা সেই পকেটগুলো একদম ধ্বংস করে দিতে চাই। আমরা এই প্রথা ভেঙে তাদেরকে আলোর মুখ দেখাতে চাই। আমরা চাই না তারা আর কারো অবহেলার পাত্র হয়ে থাকুক।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘চা শ্রমিকদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারা যখনই প্রয়োজন মনে করবেন তখন ডাক দবেন, ডাক দিতে সময় লাগবে, কিন্তু আমাদের পৌঁছাতে সময় লাগবে না। আমরা একটি দুষমুক্ত সৃষ্টের সমাজ গড়তে চাই। তবে একা পারব না, সবার সমর্থন লাগবে। যদি সব ঘর থেকে বের হয়ে আসি তাহলে দুষ্টরা পালাতে বাধ্য হবে। আমরা সবাই এই দেশের মালিক। এই সমাজ থেকে দুবৃত্তপনা দূর করব, এই দেশ আমাদের। দল, মতের উর্ধ্বে উঠে এই দেশকে ভালোবাসব এবং দেশ গড়ব।’
তিনি বলেন, ‘আমি কুলাউড়ার মানুষ। কুলাউড়ায় বারবার আসব। অনেকে আবার মনে করতে পারেন, আমি নির্বাচনের জন্য কুলাউড়ায় এসেছি, আসতে পারি নাও আসতে পারি। নির্বাচন আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, আমার জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের গায়ের সাথে লেগে থেকে মানুষের ঋণ পরিশোধ করা। আজকে আমার এই পর্যায়ে আসতে আমি বিশ্বাস করি এ দেশের সকল নাগরিকের অবদান রয়েছে।’
মতবিনিময় সভায় কুলাউড়া উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আব্দুল মুন্তাজিমের সভাপতিত্বে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির ফখরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা পল্টন থানা জামায়াত ইসলামীর আমির শাহীন আহমেদ খান, মৌলভীবাজার জেলা জামায়াতের আমির সাহেদ আলী, জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুর রহমান, সেক্রোটারি ইয়ামীর আলী, কুলাউড়া উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির আব্দুস সোবহান, সাবেক আমির আব্দুল হামিদ খাঁন, জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলাম, কুলাউড়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল আহমেদ চৌধুরী, জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন প্রমুখ।
চা-শ্রমিকদের মধ্যে বক্তব্য দেন জয়চন্ডী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চাশ্রমিক নেতা মিলন বৈদ্য, চা শ্রমিক ইউনিয়ন লংলা ভ্যালির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জু গোস্বামী প্রমুখ।
এ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এর আগে সকালে ব্রাহ্মণবাজারে জামায়াত ইসলাম সমর্থিত এক মহিলা সমাবেশে অংশ নেন।
দুপুরে উপজেলার জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে উপজেলার ওয়ার্ড দায়িত্বশীল সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শত নির্যাতিত হওয়ার পরেও আমাদের কর্মীরা অনেক ধৈর্য ধরেছেন, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়নি। আমাদের কর্মীরা বালুমহাল, জলমহাল নিয়ে লড়াই করেননি। সরকারের বিভিন্ন পদ-পদবির দখল-দাবি হাতে নেননি। আমরা ধৈর্য ধরেছি, আরো ধরব, এতেই আমাদের সৌন্দর্য। আমরা নিজের শান্তি-চাহিদাটুকু প্রিয় জনগণের জন্য উপহার দিয়ে বাংলাদেশকে ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে তুলতে চাই।’
এমআর/টিএ