ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধ: ইরানই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তির মূল চাবিকাঠি

গত কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে করণীয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়েও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানুয়ারিতে জানিয়েছে- তারা ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে।

যদিও পরে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও ইরানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তবু পুরো পরিস্থিতিতে অস্থিরতার ঘনঘটা রয়ে গেছে।

তবে আশঙ্কার চেয়ে সম্ভাবনা বড়। বহু পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে সবচেয়ে ভয়ানক পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে ঠিক উল্টো- পারমাণবিক ইরানই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে।

ইরান সংকট ৩টি সম্ভাব্য পথে এগোতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা যদি সফল হয়, তবে ইরান হয়তো পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে পারে। তবে ইতিহাস বলছে, যেসব দেশ এই পথে এগিয়েছে, তারা সহজে পিছু হটে না। যেমন উত্তর কোরিয়া, নিষেধাজ্ঞার পরও পারমাণবিক শক্তিধর হয়েছে। ইরান যদি মনে করে অস্ত্র তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি, তবে নিষেধাজ্ঞা উল্টো তাদের আরও প্রতিরোধী করে তুলবে।

দ্বিতীয় পথ হলো ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন- অর্থাৎ তারা সরাসরি বোমা তৈরি না করেও এমন অবস্থানে পৌঁছাবে, যেখানে খুব কম সময়েই অস্ত্র বানানো সম্ভব। জাপান এর উদাহরণ, যার শক্তিশালী পরমাণু অবকাঠামো থাকলেও তারা এখনো বোমা বানায়নি।

ইরানও এই পথ নিতে পারে। এতে তারা অভ্যন্তরীণ চাপে কিছুটা স্বস্তি পাবে এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ধাক্কা এড়াতে পারবে। তবে এই কৌশল সব সময় সফল নাও হতে পারে- বিশেষত ইসরায়েলের জন্য, যারা এমন সক্ষমতাকেও হুমকি মনে করে এবং যেকোনো সময় নাশকতা বা হামলার পথ নিতে পারে।

তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হলো- ইরান সরাসরি পারমাণবিক পরীক্ষা করে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এমন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মনে করলেও ইতিহাস বলছে, নতুন পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোকেই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়। বরং অনেক সময় এতে ভারসাম্য তৈরি হয় এবং সংঘাত কমে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচেটিয়া পারমাণবিক আধিপত্য চার দশক ধরে চলেছে। এটি-ই এ অঞ্চলের বড় অস্থিতিশীলতার উৎস। যদি ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয়, তবে সেটিই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসরায়েল যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, ইরানের বেলায়ও তেমন পদক্ষেপ নিতে পারে তারা। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয় এবং ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের প্রতিরোধ তৈরির প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।

এতসব উত্তেজনার মধ্যেও ইরানকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘উন্মাদ’ হিসেবে দেখার প্রবণতা অনেক বিশ্লেষকের মধ্যে আছে। কিন্তু বাস্তবে ইরানি নেতৃত্ব বরং অনেক বেশি বাস্তববাদী ও টিকে থাকার কৌশলে বিশ্বাসী। তারা চড়াও বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় না- যা ২০১২ সালে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করার মধ্যেই স্পষ্ট।

বলা হয়, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে কিংবা অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো বরং আরও সতর্ক হয়ে পড়ে- চীন, ভারত বা পাকিস্তানের মতো। আর পারমাণবিক প্রযুক্তির নজরদারি এত উন্নত যে, অস্ত্র পাচার করলে ধরা পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার আশঙ্কাও বাস্তবসম্মত নয়।

আরেকটি সাধারণ আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হলে অন্য মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই বিস্তার নিয়ন্ত্রিতই থেকেছে। ১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পরও এই অঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার হয়নি।

ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ বলছে, পারমাণবিক ভারসাম্য যুদ্ধ নয়, বরং স্থিতিশীলতা বয়ে আনে। এই বাস্তবতা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেও প্রযোজ্য হতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে তার অস্তিত্বকে মেনে নিতে বাধ্য হবে বাকিরা, এবং পারস্পরিক প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি নিরাপত্তাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

সুতরাং, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে বেপরোয়া পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার নেই। বরং নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে সংলাপ অব্যাহত রাখা উচিত। কারণ, খোলামেলা যোগাযোগ ও কূটনৈতিক বোঝাপড়া একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থানকে সহজ করবে।

সবশেষে, ইতিহাস বলছে- যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে ভারসাম্য। অস্ত্র যতই ভয়ংকর হোক, সেগুলোর উপস্থিতিই অনেক সময় সংঘাত ঠেকানোর প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যও এর ব্যতিক্রম হবে না। এজন্যই বলা যায়, পারমাণবিক ইরানই হতে পারে এই অঞ্চলে টেকসই শান্তির মূল চাবিকাঠি।

আরআর

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হিলি স্থলবন্দর দিয়ে বেড়েছে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি, কমেছে দাম Dec 15, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ায় বন্দুক হামলার ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে ১৬ Dec 15, 2025
img

চানখারপুলে ছয় হত্যা

হাবিবুর রহমানসহ ৮ আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু আজ Dec 15, 2025
img
ওসমান হাদির ঘটনায় মেহেরপুর সীমান্তে বিজিবির নিরাপত্তা জোরদার Dec 15, 2025
img
এমবাপে ও রদ্রিগোর গোলে আলাভেসের বিপক্ষে স্বস্তির জয় রিয়াল মাদ্রিদের Dec 15, 2025
img
এলাকার উন্নয়নে ঐক্যের আহ্বান হাবিবুর রশিদ হাবিবের Dec 15, 2025
img
শব্দদূষণকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে: রিজওয়ানা হাসান Dec 15, 2025
img

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ

হলান্ডের জোড়া গোলে ক্রিস্টাল প্যালেসকে বড় ব্যবধানেই হারাল ম্যানচেস্টার সিটি Dec 15, 2025
img
আজ ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হবে সিঙ্গাপুর Dec 15, 2025
img
১৫ ডিসেম্বর: ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা Dec 15, 2025
img

বুন্ডেসলিগা

টেবিলের তলানির দলের বিপক্ষে কোনোমতে হার এড়াল বায়ার্ন মিউনিখ Dec 15, 2025
img
ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রবাসীদের দেশ গড়ায় অবদান রাখার আহ্বান Dec 15, 2025
img
সিডনির ঘটনায় প্রশংসায় ভাসছেন মুসলিম ফল ব্যবসায়ী Dec 15, 2025
img
বৃহস্পতিবারের মধ্যে চূড়ান্ত হচ্ছে বিএনপির শরিকদের আসন Dec 15, 2025
img
ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় মামলা Dec 15, 2025
img
তুরস্কে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত Dec 15, 2025
img
অস্ত্রসহ সাবেক রেলমন্ত্রীর সহচর গ্রেপ্তার Dec 15, 2025
img
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হাঙ্গেরি Dec 15, 2025
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে ন্যাটোপ্রধানের মন্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন: মস্কো Dec 15, 2025
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে যা বললেন ইনকিলাব মঞ্চের জাবের Dec 15, 2025