পুলিশের হারিয়ে যাওয়া মোরালটা ফিরিয়ে আনা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিগেস্ট চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেছেন, আর কোনো রিফর্ম আপনারা এ সরকারের কাছে আশা করবেন না। সময় নাই, শেষ হয়ে গেছে। একমাত্র টার্গেট পুলিশের মোরালটাকে ফিরিয়ে আনা।
শনিবার (৫ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির আয়োজিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার : প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
মাহমুদুর রহমান বলেন, গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র পথ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন হলেও বর্তমান পুলিশ দিয়ে সেটি সম্ভব কি না? প্রি রেভ্যুলেশন বাংলাদেশে পুলিশ একটা দানবীয় পুলিশ ফোর্স ছিল, পোস্ট রিভ্যুলেশনে আজকের পুলিশ ফোর্স ডিমোরালাইড, এটা হচ্ছে বাস্তবতা।
গণঅভ্যুত্থানের পরে আগের অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে টার্গেট– ফ্যাসিবাদ যেন এই বাংলাদেশে ফিরে না আসে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সব সংস্কারের উদ্দেশ্য একটাই যে আরেকটা ফ্যাসিবাদ যেন এই বাংলাদেশে ফিরে না আসে। ফিরে না আসতে হলে প্রথমে যে কাজটা করতে হবে, গণতন্ত্র উত্তরণ করতে হবে। উত্তরণের রাস্তাটা কী? একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন যদি করতে হয়, আমি কি পুলিশ ছাড়া করতে পারব? দ্যাটস অ্যা বিগ চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি পটিয়া থানা ঘেরাও করে ওসিকে সরাতে বাধ্য করা এবং পাটগ্রাম থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তুলে ধরে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, এরকম যদি ঘটতে থাকে, আমি এই ডিমোরালাইজ পুলিশ দিয়ে কীভাবে একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করব? থানায় আক্রমণ করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর হতে পারে না। এরকম একটা পুলিশ দিয়ে আমি শঙ্কিত, আসলেই কি একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করতে পারব?
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ও এর ফলাফল নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন প্রতিদিন মিটিং করছে, আসলে জানি না এটার রেজাল্ট কী হবে। অন্তত একটা তো চাই আমরা, আপনারা একটা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন। আর সেটা তৈরি করতে হলে পুলিশের মনোবল অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এখনই শুরু করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলো বিশৃঙ্খলা করলে গণতন্ত্র উত্তরণ সম্ভব না। আর সেটা না হলে বাংলাদেশের কী পরিণতি হবে, আশঙ্কা বোধ করি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, আপনাদের হাতে সাত মাস সময় আছে। অন্তত একটা কাজ করে যান, এই র্যাব থেকে সামরিক কর্মকর্তাদের উইথড্র করে যান। এই রিফর্মটুকু যদি করে যেতে পারেন আপনাদের দেশবাসী মনে রাখবে। আমার এলিট ফোর্স লাগবে পুলিশে কিন্তু এলিট ফোর্স মাস্ট বি কম্পোজড বাই পুলিশ ইটসেলফ। তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য সেনাবাহিনীতে পাঠান। কিন্তু সামরিক বাহিনী ঢুকিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ করবেন না।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, পুলিশের মধ্যে ব্রাহ্মণ রিক্রুট করার জন্য বিসিএস আছে। নমঃশূদ্র, অচ্ছুত ও নিম্নবর্ণের লোকদের নিয়োগ করার জন্য কনস্টেবল, এসআই, ইনসপেক্টর পদ আছে। আলাদা রুট আছে। অথচ ইংল্যান্ডে, যাদের আইন দিয়ে আমাদের পুলিশ চলে তাদের রিক্রুটের জন্য তো আলাদা রুট নাই। আজকে সব অফিসারদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেই সংখ্যাটা কত? ছয় হাজার সামথিং। দুই লাখ ফোর্সের কোনো রিপ্রেজেন্টেশন নাই, যারা কনস্টেবল, যারা ইন্সপেক্টর, এসআই। এখানেও ব্রাহ্মণদের জন্য ব্রাহ্মণদের স্বার্থে ব্রাহ্মণরা এসে আলোচনা করছে, ফিউচারে ব্রাহ্মণদের কীভাবে প্রফেশনাল করা যায়। দুই লাখের রিপ্রেজেন্টেশন নাই কেন?
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর বলেন, সেনাবাহিনী ক্ষণিকের জন্য পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু কোনোমতেই আর্মি সেটা রিপ্লেস করতে পারে না। পুলিশের কাজটা পুলিশকেই করতে হবে। পুলিশকে সাহস ও সক্ষমতা সবাই একসঙ্গে দিতে হবে। সেনাবহিনী সিভিলিয়ান পাওয়ারে রিপ্লেস হচ্ছে মানে এটা পুলিশের ব্যর্থতা। এটা কখনোই কোনো দেশের জন্য, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুসংবাদ নয় যে সেনাবাহিনী বের হচ্ছে পুলিশের ডিউটি করার জন্য। এভরি টাইম মিলিটারি ডেপ্লয়েড ইন দ্য ফেলিওর অব পুলিশ।
বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, এ দেশে পুলিশের ও আমলার সফলতার কোনো শেষ নাই। কিন্তু তাদের বিফলতা অনেক। তারা বছরের পর বছর সফলতা দেখিয়েছে কিন্তু গত ১৭ বছর তাদের ভূমিকা ছিল একদলীয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, পুলিশ সংস্কারের আলোচনা খুব বিলম্বিত। পুলিশ বিভাগ স্বয়ং সংস্কারটি চায়, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিষয়টি যায়নি। যতদূর জানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে বাধাটা। ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে প্রস্তাবগুলো পাঠিয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কি অ্যাড্রেস করা হয়েছে? যেখানে পুলিশ বাদ যাচ্ছে, তাহলে এ আলোচনার মানে কি? অল আর অ্যারেঞ্জড শো।
তিনি আরও বলেন, সারাক্ষণ গল্প আর গোলটেবিল বৈঠক দিয়ে কিছু হবে না। এ জাতি ধ্বংস হয়েছে বৈঠকের কারণে।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাবেক ডিআইজি ড. মো মতিয়ার রহমান। আরও বক্তব্য দেন সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক ডিআইজি ড. এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এসএম জহিরুল ইসলাম।
এফপি/ টিকে