বিশ্বদীপ দে: ‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া-/ পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’ কিনু গোয়ালার গলির বাসিন্দা সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানির বিয়ে করার সাহস হয়নি। নিজেই বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে পালিয়ে এলেও সে ভুলতে পারেনি ধলেশ্বরী নদীতীরের মেয়েটিকে। মনে মনে কল্পনা করেছে তাকে। যার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে টকটকে সিঁদুরের ঝলমলে ছোঁয়া। রবি ঠাকুরের কবিতায় হরিপদ কেরানির মনের ভিতরে এই স্থির নারীমূর্তির স্টিরিওটাইপ বাঙালির হৃদয়ে, সে নারী হোক বা পুরুষ, এক অসামান্য জলছাপের মতো হয়ে রয়েছে।
আধুনিকা নারীও শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে রহস্যের কুয়াশা বুনে দিতে জানে। কিন্তু বলিউড? সে কি তার ছবিতে বাঙালি নায়িকাকে শাড়ি পরাতে চায় রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে? বলা মুশকিল। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, বাঙালি মেয়ে মানেই তার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, পরনে শিফন শাড়ি। আর না হলে দজ্জাল, মুখরা! এর বাইরে কেন ভাবতে পারল না টিনসেল টাউন?
সম্প্রতি ওটিটি মঞ্চে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আপ জ্যায়সা কোই’ ছবিতে ফতিমা সানা শেখ মধু বোস নাম্নী এক বঙ্গকন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নতুন করে তারপর থেকেই ভাসছে বলিউডের রুপোলি পর্দায় ফুটে ওঠা বাঙালি মেয়েদের স্টিরিওটাইপ। এর আগে ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি তথা আরআরকেপিকে নামের ছবিটিতে দেখা মিলেছিল রানি চ্যাটার্জির। ভূমিকায় আলিয়া ভাট। পাশাপাশি এই দুই চরিত্রকে দেখলে মনে হবে যেন আয়নার সামনে ও ভিতরের দুই মূর্তি! আলিয়ার পরনের শিফন শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজে উপচে পড়ছে স্নিগ্ধ যৌন আভা। একই পোশাক ফতিমা সানা শেখের পরনেও!
সাংস্কৃতিক আবহ যেন অদৃশ্য চালচিত্রের মতো দু’জনকেই অনুসরণ করে বেড়ায়। বিরাট বড় দেশ ভারতবর্ষ। যার পূর্বপ্রান্তে বঙ্গদেশ। যিনি কখনও এই মুলুকে আসেননি, নিজের এলাকায় বাঙালি মেয়ে দেখেননি, তিনি এই ধরনের সিনেমা দেখে বঙ্গললনাদের এই স্টিরিওটাইপকেই সামগ্রিক ভেবে বসতেই পারেন!
বাঙালি পুরুষকেও এক সরস ভাঁড়ের ভূমিকায় যেন দেখা গিয়েছে বছরের পর বছর। এক নিপাট কমিক রিলিফ। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। ‘আনন্দ’ ছবিতে ড. ভাস্কর ব্যানার্জির মতো চরিত্রকে ভুললে চলবে না। কিন্তু সে তো নিছক ব্যতিক্রমই। বাঙালি মেয়েদের ক্ষেত্রেও খুঁজলে ব্যতিক্রম মিলবে। উদাহরণ হিসেবে মনে পড়ছে ‘পিকু’ ছবির দীপিকা পাড়ুকোনকে। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা বছর তিরিশের পিকু ব্যানার্জি তার বাবার সঙ্গে থাকে। ২০১৫ সালে সুজিত সরকার পরিচালিত ছবিটিতে প্রবাসী বাঙালিনী পিকুর মিষ্টি বাঙালিয়ানা মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের।
সেখানে কিন্তু শাড়িকে সেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। ছবিটি যেমন ছকভাঙা, পরিচালক সুজিত সরকারও এখানে বাঙালি মেয়েদের নির্দিষ্ট ফ্রেমে আটকে রাখতে চাননি। পিকু স্বাধীনচেতা, স্বাভাবিক একটি চরিত্র। রক্তমাংসের বলেই মনে হয় তাঁকে। একটি দৃশ্যে পিকুকে বলতে শোনা যায়, সেও তার বাবার মতোই সময়ে সময়ে বিরক্তিকর ও বিচিত্র স্বভাবের। এবং সেটা সে ভালো করেই জানে। এই বাস্তবতাকে আড়াল করতে চায় না পিকু। অথচ ছবিতে বাবাকে নিয়ে তার উদ্বেগ আমাদের বুঝিয়ে দেয় এই বিরক্তির উৎস প্রবল ভাবে ভালোবাসতে পারার ক্ষমতাই।
বাইরে বাইরে সে যেমনই হোক, ভিতরে ভিতরে সে এক স্নেহশীলা নারীই। তাঁর হৃদয়ের ভিতরে রয়েছে সজল এক ক্ষেত্রও। এই বৈপরীত্যই আমাদের চেনা কোনও মানুষীর অবয়বের সঙ্গে সাযুজ্য এনে দেয় পিকুর। তাকে কাচের আড়ালের ম্যানিকুইন-সদৃশ হতে দেয় না। এবং বিদ্যা বসু। সুজয় ঘোষের ‘কাহানি’ আগাগোড়াই এগিয়ে গিয়েছিল বিদ্যা বালন অভিনীত চরিত্রটির স্বামীকে অন্বেষণকে ঘিরে। চরিত্রটিকে শেষপর্যন্ত ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসেবে গড়লেও সুজিতের মতো সুজয়ও কিন্তু চরিত্রটিকে ‘বঙ্গকন্যার পুতুল’ হতে দেননি। পরিচালকরা বাঙালি বলেই কি স্টিরিওটাইপের হাঁটতে পেরেছিলেন তাঁরা?

এই ব্যতিক্রমের উলটো দিকেই রয়েছে রানি কিংবা মধুরা। ‘দেবদাস’ (২০০২) এক কিংবদন্তি বাঙালি লেখকের চিরকালীন প্রেমকাহিনির সেলুলয়েডে বর্ণিত কাহিনি হলেও সঞ্জয় লীলা বনশালি উপন্যাস অনুসরণ করেননি। চন্দ্রমুখী ও পার্বতীর একসঙ্গে কোমর দুলিয়ে ‘ডোলা রে ডোলা’ ভাগ্যিস শরৎবাবুকে দেখে যেতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ সাধারণ মেয়ের গল্পই লিখতে বলেছিল তাঁকে। কিন্তু সেসবে পাত্তা-টাত্তা দেননি সঞ্জয়। বিগ বাজেটের ছবিতে নায়িকাকে শাড়ি-গয়নার সমাহারে এক কৃত্রিম মূর্তি হিসেবে স্থাপন করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। ছবিতে দেখানো অতিকায় জমিদার গৃহের মতোই চরিত্রগুলি কেবল পরিচালকের অঙ্গুলীহেলনেই যেন নড়াচড়া করত, এমনই আজগুবি!
যাই হোক, মধু বোসে ফেরা যাক। কিংবা রানি চ্যাটার্জি। এই বঙ্গকন্যারা একদিকে সাংস্কৃতিক, অন্যদিকে উদারমনা এবং স্বাধীন মনোভাবাপন্ন। সে যেন দিনরাত সুযোগ পেলেই রবি ঠাকুর গুনগুন করে, শরদিন্দু পড়ে কিংবা যামিনী রায়ের ছবি দেখে। তাদের বাস অতিকায় বাড়িতে! আর যাই হোক, একে চেনা বাঙালি মেয়ে কিংবা তার ঘরবাড়ির সঙ্গে মেলানোই দুষ্কর।
আর এপ্রসঙ্গেই মনে পড়ে ‘ভিকি ডোনার’ (২০১২)। ভিকির মায়ের বাঙালি মেয়ে পছন্দ ছিল না। পাঞ্জাবি ললনার বদলে ছেলে মন দিয়েছে বাঙালি যুবতী অসীমা রায়কে- এ তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাকে বলতে শোনা যায়, ”নামটাই যদি এত টক হয় তাহলে মেয়েটা কেমন হবে কে জানে!” এরপরই তার মন্তব্য, ”জানিস, কেমন ডমিনেটিং নেচার ওদের?” অসীমাকে অবশ্য সেই অর্থে ‘ডমিনেটিং’ বলা যায় না। সুজিত হয়তো সেটা প্রতিষ্ঠা করতেই পাঞ্জাবি মহিলার মুখে এহেন মন্তব্য বসিয়েছিলেন। কিন্তু কেবল এই সংলাপটুকুই যে মনোভাবকে বোঝায়, তেমনটা কি বলিউডের বাঙালিনী চরিত্রে আমরা দেখিনি?
‘গ্যাংস অফ ওয়াশিপুর’-এর প্রথম পর্বে (২০১২) দেখা মিলেছিল দুর্গা নাম্নী এক চরিত্রের। রীমা সেন অভিনীত দুর্গা সর্দার খানের (মনোজ বাজপেয়ী) দ্বিতীয় স্ত্রী। তাকে ও তার ছেলেকে প্রাপ্য স্বীকৃতি না দেওয়ায় শেষপর্যন্ত সে কীভাবে সর্দারের মৃত্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা সকলেই দেখেছেন। তবে এই চরিত্রটিকে স্টিরিওটাইপ বলা চলে না। এখানে কোনও পূর্ব নির্ধারিত ধারণাকে এঁটে দেওয়া হয়নি। কিন্তু বাঙালিনীর এই রূপ বলিউডে এভাবেও থেকে গিয়েছে।
বাঙালি কি একই রকম আছে? দ্রুত বদলাতে থাকা পৃথিবীতে আর সব কিছুর মতো বাঙালি রমণীও বদলেছে। তবে শহরে তার যে মূর্তি, তা গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলে আলাদা আজও। একা লড়াই করা কিংবা পরিবারের ভিতরে থেকেও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া- বহুমাত্রিক বঙ্গললনার প্রকৃত ছবি বলিউডের দূরবিনে ধরাই পড়তে চায় না। স্বাধীনচেতা বাঙালি কন্যার যে ছবি সে আঁকে তাতেও বিস্তর গোলমাল। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র (১৯৬০) নীতারা আজও আছে। তাদের কি চিনতে চায় না সাগরপাড়ের বিনোদুনিয়া? অন্তত সাম্প্রতিক ছবির ক্ষেত্রে তেমন উদাহরণ অনেক চেষ্টা করেও মনে পড়ল না।
এমকে/এসএন