টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘জুলাই আন্দোলনে যে আদর্শের জন্য ছাত্ররা রাজপথে গড়াগড়ি খেয়েছিল। আজ কোথায় গেল সেই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা।’
সম্প্রতি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় এ কথা বলেন তিনি।
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সেদিন রাতেই হঠাৎ খবর এলো রাজধানীর গুলশানের অভিজাত এলাকার বাসা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক পাঁচ তরুণ।
প্রথমে ভেবেছিলাম আবার কোনো পুরনো দলের ছাত্রসংগঠনের চিহ্নহীন ক্যাডাররা হবে। কিন্তু না নাম দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি সেই তরুণদের একজন, যাদের আমরা মনে করেছিলাম নতুন বাংলাদেশের ধারক ও বাহক।
অথচ তার বাসা থেকেই উদ্ধার হয়েছে প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক। আর এই রিয়াদকে যখন আদালতে নেওয়া হয়, তখন খবর আসে যে তিনি গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। না দিলে তাকে পুলিশের ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কোথায় গেল সেই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা।
সেই আদর্শ যার জন্য ছাত্ররা রাজপথে গড়াগড়ি খেয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নগুলো আজ বাংলাদেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের মনে দানা বাঁধছে। কারণ ঘটনাটি একক কোনো ব্যক্তির বিচ্যুত নয় বরং একটি ধারাবাহিক পচনের বহিঃপ্রকাশ। যেখানে নতুন বন্দোবস্ত নামের বেলুনটি দিনের আলোতেই চুপসে পড়ছে। আমরা যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম।
নতুন বাংলাদেশ বলতে অন্যরা যে রকম বলছে আমি তেমনটা বলছি না। পরিবর্তিত আরো আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা জানতাম একদিন না একদিন শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটা গণ-অভ্যুত্থান হবে। সেই দিনটি এলো ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। রাজপথে লাখো মানুষ ছাত্র-জনতার ঢল, গণসংযোগ, ব্যানার, পোস্টার, গ্রাফিতি সব কিছু মিলিয়ে মনে হয়েছিল বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির একটা নতুন সূর্য উঠেছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর যাদের হাতে আমরা নেতৃত্ব দিয়েছিলাম বা যারা নিজেরাই নিয়ে নিয়েছিলেন আসলে। তাদের অনেকেই আজ চাঁদাবাজি, ঘুষ, কমিশন, টেন্ডার বাণিজ্য প্রভাব বিস্তার আর দখল পাচালির জালে জড়িয়ে পড়েছে।’
সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলম মাহির বিরুদ্ধে সাড়ে ছয় কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। আবার সেই একই অভিযোগে তার ভাই মাহফুজ আলম যিনি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা তাকেও অভিযুক্ত করা হচ্ছে। যদিও তিনি পাল্টা পোস্টে এসব অভিযোগকে বড় ষড়যন্ত্র বলছেন। তবু যে প্রশ্নগুলো উঠছে তা কিভাবে চাপা দেব?’
তিনি বলেন, ‘এনসিপির অন্যান্য নেতা বা যারা সরকারে ছিলেন উপদেষ্টা তাদের বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগ আছে এবং অভিযোগ শুধু তাদের বিরুদ্ধে নেই। তাদের বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। অভ্যুত্থানের কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে ছাত্রনেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, ঘুষ চাইলে ঘুষি মারুন। আজকে সেই ছাত্র আন্দোলনের বহু নেতার বিরুদ্ধেই ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ এবং এই অভিযোগগুলো নতুন নয় অনেক পুরনো। আমি কিন্তু অনেকবার বলেছি যে কোনো কিছুই লুকানো না, সব রেকর্ড হচ্ছে নানা জায়গায় নানাভাবে। সময়মতো সব বেরিয়ে আসবে হচ্ছে কিন্তু তাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উমামা ফাতেমা নামের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক সাবেক মুখপাত্রের ফেসবুক লাইভ তো অনেকের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। তিনি বলেছেন জুলাই অভ্যুত্থান অনেকের কাছে মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে। এই কি ছিল নতুন পথ? জুলাই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়, একটি স্বপ্নের জন্ম ছিল। একটি শুদ্ধ আগুনের জাগরণ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম ছাত্ররা আদর্শ নিয়ে পথ দেখাবে। নতুনদের হাতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যাবে। রাজনীতি হবে জনমুখী এবং দায়বদ্ধ।’
এই টিভি উপস্থাপক বলেন, ‘ছাত্ররা পথ দেখাবে মানে এই নয় যে ছাত্ররা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেবে। কারণ ছাত্রদের তৈরি হতে হবে। লেখাপড়া করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে। গোটা পৃথিবীটাকে জানতে হবে এবং পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে হবে। সেই কাজ না করেই হঠাৎ আন্দোলন থেকে সরকারে গিয়ে বসা এবং সেখানে আমাদের কিছু বয়োবৃদ্ধ মানুষদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের। যেভাবে দিয়েছে সেই দায়টাও কিন্তু আমাদের বয়োবৃদ্ধেরও নিতে হবে। এমনকি সরকারপ্রধানকে নিতে হবে। তারা কোনো দিনই ছাত্রদের ক্লাসে যাওয়ার কথা বলেননি, লেখাপড়া করবার কথা বলেননি।’
এসএন