এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা একচ্ছত্র শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেই শূন্যতা পূরণে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রতি ছিল অসীম আশাবাদ; মনে করা হয়েছিল এখান থেকেই একটি নতুন, গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের সূচনা হবে।
কিন্তু আজ এক বছর পর সেই আশার জায়গায় ঘনীভূত হয়েছে হতাশা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারে বিলম্ব, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগহীনতা এবং প্রশাসনিক সংস্কারে স্থবিরতা—এই সব মিলিয়ে ইউনূস সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল। আলজাজিরা, রয়টার্সসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এই ব্যর্থতাকে শিরোনাম করে তুলেছে, যা নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক সতর্ক সংকেত। বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি এখন যেন পরিণত হয়েছে আরেকটি অনিশ্চয়তা ও হতাশার অধ্যায়ে।
আন্দোলনে নিহতদের সুষ্ঠু বিচারের দাবি ছিল এই সরকারের কাছে অন্যতম প্রত্যাশা; যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের সদস্যসহ মানবাধিকার কর্মীদের।
জুলাই আন্দোলনে নিহত ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাচ্চারা যে উদ্দেশ্যে জীবন দিয়েছে, সেইভাবে একটি স্বৈরাচারমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, গুম-খুনহীন, টেন্ডারবাজিমুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন তারা দেখেছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমরা সেই সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলতে চলেছি।’
জুলাই আন্দোলনে নিহত ফাইয়াজের খালা নাজিয়া খান বলেন, ‘আমার শুধু একটাই আশা—আল্লাহ যেন আমাকে ততদিন বাঁচিয়ে রাখেন, যেদিন আমি সেই খুনিকে বিচারের মুখোমুখি হতে দেখতে পারি।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘এই মামলাগুলোকে সরকারের পাশাপাশি তদন্তকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। যদি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কার্যকরভাবে তদন্ত পরিচালিত হতো তাহলে ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যেই আমরা চার্জশিট দাখিল হতে দেখতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো পর্যন্ত তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।’
গত এক বছরেও সরকার জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারেনি। সাধারণের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে এলিটদের সঙ্গে আলোচনা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেন তারা।
এমনটাই অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক আসিফ এম শাহানের। তিনি বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে কোনো মেলবন্ধন নেই এই সরকারের। মূলত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেই তারা বেশি আলোচনা করেন। এলিটদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেন। সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ জনগণের মতামত নেই বললেই চলে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজনীতিতে খুবই নোংরা খেলা চলছে। কোনো পরিবর্তনই আমার চোখে পড়ছে না। দিন দিন আরো হতাশা বাড়ছে।’
জুলাই আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্ন্তবর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও। আলজাজিরা, রয়টার্সসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের দৃশ্যমান সংস্কারের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে তাদের স্বার্থের দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকারকে। এমনটাই বলা হয়েছে আলজাজিয়ার প্রতিবেদনে।
এছাড়াও দেশব্যাপী এখনো মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে অস্থিরতা চলছে। যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা দেখাতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসন। এসব ঘিরে তাই এই সরকারের প্রতিও আস্থা কমেছে জনগণের।
এসএন