জাবির ১৪০০ কোটি টাকার প্রকল্পের ছয় পার্সেন্ট চাঁদা দাবি শোভন-রাব্বানীর

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪১ ধরনের কাজ ও কেনাকাটা হবে। এর মধ্যে ২৩টির মতো ভবন নির্মিত হবে। বিপুল এই উন্নয়ন প্রকল্পের ৪-৬ পার্সেন্ট চাঁদা দাবি করেছেন বলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক প্রথম আলোতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে।

খবরে বলা হয়, ৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে এই চাঁদা চান দুই নেতা। উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে- এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা বাজে আচরণ করেন।

ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৩৫০ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ে আগের মতো চার-পাঁচতলার কয়েকটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। পরে সরকার ১০ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত ভবন করার পক্ষে মত দেয়। গত জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাড়ে ১৪ শ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আওতায় ২০২২ সালের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাদের জন্য অনেকগুলো বহুতল ভবন হওয়ার কথা।

গত ৩০ মে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি আবাসিক হলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। প্রথমে ই-টেন্ডার না হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর সনাতন পদ্ধতিতে দরপত্র গ্রহণ শুরু হওয়ার সময় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করে জানায়, ছাত্রলীগের ২০-৩০ জন নেতা-কর্মী তাঁদের কেনা দরপত্র ছিনিয়ে নিয়েছেন।

এর মধ্যেই ঢাকা–আরিচা মহাসড়ক লাগোয়া ক্যাম্পাস এলাকায় ছাত্রীদের দুটি হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত ২২ জুলাই ছাত্রীদের দুটি হল নির্মাণের স্থানে গাছ কাটা শুরু হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ বাধা দেয়। এরপর ৩ আগস্ট একই স্থানে আবার গাছ কাটা শুরু হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখনো বাধা দেন। এর মধ্যেই শুরু হয় ঈদের ছুটি। ছুটি শেষে দেখা যায়, ওই স্থানের গাছ কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

গত ২৩ আগস্ট সকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘিরে ছেলেদের তিনটি হল নির্মাণের স্থানে গাছ কাটা শুরু করেন শ্রমিকেরা। তখন সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই দিনই উন্নয়নকাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ছাত্রলীগকে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার অভিযোগ প্রকাশ পায়। তখন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ টানা আন্দোলন করে আসছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি আলোচনা করেছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমার প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন করছে, তারা দুর্নীতির প্রমাণ করুক।’

ঈদুল আজহার আগে ৮ আগস্ট রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ভিসির বাসভবনে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এ সময় তারা ভিসিকে উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পাওয়া কোম্পানি থেকে কয়েক পার্সেন্ট টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু ভিসি তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে তারা রূঢ় আচরণ করেন।

এ বিষয়ে ভিসি বলেন, ‘সেদিন তারা (শোভন ও রাব্বানী) আমাকে বলে, এত বড় প্রকল্প, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব। আপনি কোম্পানিগুলোকে বলে দেন তারা যেন আমাদের কিছু (পার্সেন্ট) টাকা দেয়। আমাদের টাকা দিলে আমরা স্থানীয় (জাবি) ছাত্রলীগকে তা থেকে কিছু দিয়ে দেব। কিন্তু আমি তাদের কথায় রাজি হইনি এবং মুখের ওপরে বলে দিয়েছি আমি কোনো টাকা-পয়সার মধ্যে নেই। তখন তারা আমাকে বলল, আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। সেজন্য আপনার কাছে এসেছি। তখনও তাদের কথায় সাড়া না দেয়ায় তারা আমার সঙ্গে বেশ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা শুরু করে। এর কিছু সময় পর তারা চলে যায়।’ তারা কত পার্সেন্ট দাবি করেছিল- এমন প্রশ্নে ভিসি বলেন, ‘দু-এক পার্সেন্ট না, তারা চার কিংবা ছয় পার্সেন্টের কথা বলেছিল।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় শোভন ও রাব্বানীর প্রসঙ্গ টেনে ভিসি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি নাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় দেখাশোনা করার জন্য তাদের (শোভন-রাব্বানী) দায়িত্ব দিয়েছেন? তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব কী? আমি তাদের কেন এ দায়িত্ব দেব? এ সময় প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন।’

ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে চলমান আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ‘সম্মানি মানুষকে কেন (তদন্ত কমিটি করে) আমরা অসম্মানিত করব? যারা আপনাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছে, তারাই প্রমাণ করুক।

কোনো উড়ো চিঠি কিংবা উড়ো খবরের ভিত্তিতে কিছু করা হবে না।’ ভিসি আরও বলেন, ‘এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে আমার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প না চায় তবে দেব না। আপনি না বলে দেন। তবে এ নিয়ে যেন আন্দোলন না হয়।’ এ সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও আড়িয়াল বিলের প্রকল্পকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেন বলেও জানান ভিসি।

ভিসির বাসভবন সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যের পর ভিসির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রাব্বানী প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন।

সোমবার রাতে রাব্বানীর অনুসারী বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবর রহমান সালেহী, ছাত্রলীগ কর্মী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪২ ব্যাচের রতন বিশ্বাসসহ চারজন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে তার বাসভবনে যান।

তবে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করে। তবে সালেহী ওইদিন ভিসির সঙ্গে দেখা করতে যায়নি বলে দাবি করেন। আর রতন বিশ্বাসের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ভিসি ম্যামের সঙ্গে দেখা করেছি, সেটা সত্য। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি মোটেও সঠিক নয়। ভিসি ম্যাম ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তার একটি টাকাও আমাদের ছিল না। অথচ বলা হচ্ছিল, আমাদের টাকা দেয়া হয়েছে। পরে তার ছেলের মাধ্যমে তিনি আমাদের কল করিয়েছেন। তখন আমরা সেখানে গিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার একটি কাজের জন্য আমাদের ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় ভাইয়ের ফার্মের জন্য বলেছিলাম। ভিসি ম্যাম সেই ফার্মকেও কাজটা দেননি। আমরা সেটা নিয়েও কিছু বলিনি। অথচ এখন উল্টো আমাদের নামে বলা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, সেখানেই আমরা কিছু করিনি। কেউ আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারেনি। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কেন করব?’

 

টাইমস/এসআই

Share this news on: