১৫৮ বছর আগে হারানো আলাস্কাতেই ইউক্রেনের জমি লিখে নেবে রাশিয়া?

১৫৮ বছর আগে মাত্র ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলাস্কা বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়া। আর ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানসূত্র খুঁজতে সেখানেই বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন ট্রাম্প-পুতিন। মার্কিন মুল্লুকের এত সব জৌলুস এলাকা বাদ দিয়ে কেন এই হিমশীতল অঙ্গরাজ্য আলাস্কাকে বেছে নেওয়া হলো? এর পেছনে রহস্য কী?

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই আলাস্কাতেই এবার পুতিন ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূমি-বিনিময় চুক্তির’ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবেন। আর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে সার্বভৌম ভূখণ্ডের একটি অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে ইউক্রেন।

এই আশঙ্কা শক্তিশালী হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখ খোলার পর। তিনি বলেছেন, আলোচনার স্থান একটি ব্যাপার বটে। আগামী শুক্রবারের শীর্ষ বৈঠকের পরিবেশ মস্কোর অনূকুলে। কয়েক মাসের ভুয়া আলোচনার পর কেন পুতিন সুযোগটি লুফে নিয়েছেন তা স্পষ্ট। এ বৈঠক হতে চলেছে ইউক্রেনকে খণ্ডবিখণ্ড করার বৈঠক, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফের প্রাথমিক প্রস্তাব শুনে কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কিত। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ইউক্রেন দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের অবশিষ্ট অংশ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, পুতিন বিনা লড়াইয়ে অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখলের ধারণা সমর্থন করেন এবং তিনি মনের মতো অংশীদার উইটকফকে পেয়েছেন। উইটকফ অতীতে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়েছেন। চার বছর ধরে আগ্রাসন চালানো রাশিয়াকে ইউক্রেনের শহরগুলো থেকে শুধু হেঁটে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। যেখানে সেই শহরগুলো রক্ষায় হাজারো ইউক্রেনীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে।

একবার ভেবে দেখা উচিত উইটকফের প্রস্তাব বাস্তবে কেমন হবে। রাশিয়া দোনেৎস্কের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহরকে (পোক্রোভস্ক ও কোস্তিয়ানতিনিভকা) ঘিরে ফেলার কাছাকাছি রয়েছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ দুই শহরের ইউক্রেনীয় সেনাদের অবরুদ্ধ করতে পারে। সেনাদের বাঁচাতে কিয়েভ হয়তো আগামী মাসগুলোতে স্বেচ্ছায় এ দুই শহর ছাড়বে।

তবে দোনেৎস্কের বাকি অংশ বিশেষত ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের চিত্র ভয়ঙ্কর। সেখানে এখনো হাজারো বেসামরিক মানুষ বাস করছেন। মস্কো আনন্দিত হবে যদি দেখে, শহরগুলো এমনিতেই খালি হয়ে গেছে এবং রুশ সেনারা বিনা বুলেটে শহর দখল করছে।

শনিবার ভোরে জেলেনস্কি জোর কণ্ঠে বলেছেন, ইউক্রেন এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়বে না। বর্তমানে তিনি একদিকে সামলাচ্ছেন সেনাবাহিনীর ক্ষোভ, অন্যদিকে জনগণের গভীর অবিশ্বাস।

ট্রাম্প যেটিকে ‘বিনিময়’ বলেছিলেন, ইউক্রেন তাতে কী ফিরে পেতে পারে? হয়তো সুমি ও খারকিভ অঞ্চলের সীমান্তবর্তী ক্ষুদ্র কিছু এলাকা, যা পুতিনের কথিত ‘বাফার জোনের’ অংশ। তবে বাস্তবে এর বেশি কিছু নয়।

প্রধান লক্ষ্য একটি যুদ্ধবিরতি, কিন্তু সেটিও কঠিন। মাসের পর মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইউক্রেন যে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি দাবি করে আসছে, পুতিন বরাবরই বলেছেন তা অসম্ভব। কারণ পর্যবেক্ষণ ও লজিস্টিকস নিয়ে প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন পূর্বঞ্চলীয় সম্মুখোগে তাঁর বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তিনি মত বদলাবেন বলে মনে হয় না।

১৯৩৮ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইনের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছে ইউরোপ। যেখানে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে ব্যর্থ শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল। ক্রেমলিনেরও বারবার চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় আক্রমণ চালানোর ইতিহাস রয়েছে।

পুতিন শুরু থেকেই তাঁর লক্ষ্য পরিষ্কার করেছেন। তিনি পুরো ইউক্রেনকে বশীভূত বা দখল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত পুনর্গঠন করতে চান, যাতে ওয়াশিংটন কিয়েভকে রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়।

পুতিনের উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বলেছেন, আলাস্কা হবে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আলোচনার জন্য চমৎকার স্থান এবং এরই মধ্যে একটি ফিরতি সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া।

ঝুঁকি রয়েছে যে, ট্রাম্প-পুতিনের পারস্পরিক সৌহার্দ্য এমন এক চুক্তির দিকে ঠেলে দেবে যেখানে ভূমি বিনিময় বা দখলের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ মস্কোর পক্ষে থাকবে। সেটি কিয়েভের সামনে উপস্থাপন করা হবে মার্কিন সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করার পুরনো আল্টিমেটামের সঙ্গে। তারপর দেখা যাবে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ আবার ট্রাম্পকে ফোন করছেন এবং এই চক্র চলতেই থাকবে। এই জয়ের জন্য পুতিনের দরকার আরও সময় এবং তিনি সেটি পেতে চলেছেন।

তাহলে অতীতের সঙ্গে এই সময়ের পার্থক্য কোথায়? ট্রাম্পের মন রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে গেল কখন? সেটি কি ওভাল অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে উত্তপ্ত মুহূর্তের সময়? দুটি উপাদান এখন আছে যা তখন ছিল না।

প্রথমত, ভারত ও চীনকে উপেক্ষা করা যাবে না। প্রথমটি দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের ঝুঁকিতে পড়েছে এবং দ্বিতীয়টি এখনো জানে না কতটা ক্ষতি হবে। দেশ দুটি গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার ক্রেমলিনে ফোন করেছে। তারা হয়তো পুতিনকে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতে অথবা অন্তত কূটনীতিতে আবার কিছুটা আগ্রহ দেখানোর প্রেরণা দিয়েছে। তারা হয়তো উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা তাদের জ্বালানি আমদানিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে পুতিনকে রাজি করাতে খুব বেশি কিছু লাগেনি। গত এক দশকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে তিনি এমন এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন, যা তাঁর দল বরাবরই ইউক্রেনে শান্তির পথে একমাত্র উপায় হিসেবে তুলে ধরেছে। আলাস্কা ও ভূমি চুক্তি নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে আরেকটি নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা গতকাল শুক্রবার পেরিয়ে গেছে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প দাবি করছেন, পুতিনকে ঘিরে তাঁর চিন্তাভাবনা বদলেছে। পুতিনকে নিয়ে এখন তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে কিছু নতুন শব্দ। যেমন; হতাশাজনক, বীভৎস, আমাকে টানছে। যদিও ট্রাম্প মস্কোকে বড় ঘা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন, তবে অতীত মনে করিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট মিত্র ও রিপাবলিকানেরা তাঁর আশপাশে রয়েছেন।

অনেক কিছু ভালোও হতে পারে। কিন্তু মঞ্চ প্রস্তুত আছে আরও অন্ধকার কিছুর জন্যই। কেননা ট্রাম্পের তৃতীয় নিষেধাজ্ঞার হুমকি উবে গেছে, পুতিনের বাহিনী ফ্রন্টলাইনে কৌশলগত অগ্রগতি পাচ্ছে এবং এক দশকে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন, যেখানে ইউক্রেনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আলোচনার টেবিলে এমন এক চুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ছে, যেখানে বিশাল ভুখণ্ড পেতে তাঁর যুদ্ধও করতে হবে না।

এক মুহূর্ত ভাবুন, এই পরিস্থিতিতে পুতিনের দম্ভ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? তবে কি এবার সাবেক কেজিবি গুপ্তচর ট্রাম্পের ওপর তাঁর তথাকথিত ‘যাদু’ প্রয়োগ করেই ছাড়বেন?

শুক্রবার এখনো ছয় দিন দূরে, কিন্তু এই দূর থেকেও দৃশ্যমান, কিয়েভের ধীর পরাজয়।


ইউটি/টিএ



Share this news on:

সর্বশেষ

img
২ হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিলেও ১ জনকে ছাড়বে না ইসরায়েল Oct 10, 2025
img
টুইঙ্কেল আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইত না: অক্ষয় Oct 10, 2025
img
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ Oct 10, 2025
img
২০২৬ বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত করল ২০ দল Oct 10, 2025
img
চলচ্চিত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ পেয়েছেন তিনিও, স্বীকারোক্তি রণবীরের Oct 10, 2025
img
ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি শুরু! Oct 10, 2025
img
শান্তিতে নোবেল ঘোষণা আজ Oct 10, 2025
img
ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র Oct 10, 2025
img

নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ

৩ ম্যাচ হেরে জটিল সমীকরণে পাকিস্তানের সেমিফাইনাল আশা Oct 10, 2025
img
ট্রাম্পকে নোবেলের জন্য মনোনীত করবে ইউক্রেন Oct 10, 2025
img
সাবেক এমপি ইকবাল ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা Oct 10, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল রাবি শিক্ষকের, সহকর্মী আহত Oct 10, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঢাকায় Oct 10, 2025
img
দূষিত বাতাসের শীর্ষ শহর লাহোর, ১০ম অবস্থানে ঢাকা Oct 10, 2025
img
শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ Oct 10, 2025
img
জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতা Oct 10, 2025
img
জামায়াত থেকে পদত্যাগ করলেন ফ্লোটিলার আলোচিত মুশতাক Oct 10, 2025
img
শহিদুল আলমকে তুরস্কের সহায়তায় মুক্ত করার চেষ্টা চলছে Oct 10, 2025
img
ভূমিকম্পের পর ‘সুনামির’ আশঙ্কা করছে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ Oct 10, 2025
img
হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করল ইসরাইলি মন্ত্রিসভা Oct 10, 2025