দেশে তামাকজনিত রোগে দিনে ৪৪২ জনের মৃত্যু

বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জন মানুষ তামাকজনিত রোগে অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। তবু বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রক্রিয়ায় সরাসরি তামাক কোম্পানির মতামত নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা। 

তাদের প্রশ্ন- যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক চুক্তি (এফসিটিসি) স্পষ্টভাবে নীতি প্রণয়নে তামাক কোম্পানির সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করেছে, তখন এই বিতর্কিত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা কোথায়?

বুধবার (১৩ জুলাই ২০২৫) রাজধানীতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘জনস্বার্থ বনাম তামাক কোম্পানির প্রভাব: তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন তরান্বিতকরণে সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় এই প্রশ্ন ও উদ্বেগ উত্থাপন করা হয়।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত কারণে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান এবং ৪ লাখের বেশি মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন জনসমাগমস্থল ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।

তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধন ছাড়া এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। অথচ সরকারের স্টেকহোল্ডার বৈঠকে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণ এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩-এর সরাসরি লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, প্রতিদিন গড়ে শত শত মানুষ যেভাবে প্রতিরোধযোগ্য কারণে মারা যাচ্ছেন, তার দায় এড়ানোর উপায় নেই। সরকার নানা অজুহাতে আইন সংশোধনে গড়িমসি করছে, বরং তামাক কোম্পানির অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে তাদের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এটি জনস্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগ যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী, এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, যা জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। তবুও জনস্বাস্থ্য রক্ষার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া না হয়ে তামাক কোম্পানিকে আইন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে- যা স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের মতে “অবিবেচনাপ্রসূত ও বিপজ্জনক” সিদ্ধান্ত।

কর্মশালায় অংশ নেওয়া সাংবাদিকরা বলেন, এফসিটিসির ৫.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন বা সংশোধনে তামাক কোম্পানিকে সম্পৃক্ত করা যাবে না। তবুও ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের খসড়ায় তাদের মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা জনস্বার্থবিরোধী এবং স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

তাদের মতে, তামাক কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা, জনস্বাস্থ্য নয়। তাই এ ধরনের মতামত গ্রহণ মানেই জনস্বার্থকে উপেক্ষা করা।

প্রস্তাবিত সংশোধনীর মূল দিকগুলো

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হল- 

১. শতভাগ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহন ধূমপানমুক্ত করা।
২. তামাক বিক্রয়স্থলে পণ্যের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা।
৩. তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
৪. ই-সিগারেট ও অন্যান্য নতুন ধরণের তামাকজাত পণ্যে কিশোর-তরুণদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করা।
৫. প্যাকেট ও কৌটায় স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা।
৬. খুচরা শলাকা, মোড়কবিহীন ও খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা।

কর্মশালায় আরও উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের উপদেষ্টা নাইমুল আজম খান, সমন্বয়ক ডা. অরুনা সরকার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, সিনিয়র যোগাযোগ কর্মকর্তা আবু জাফরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। 

ইউটি/এসএন


Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রসেনজিৎকে নিয়ে আফসোস বাবা বিশ্বজিতের Oct 10, 2025
img
আমরা কারো সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা করিনি : নুর Oct 10, 2025
img
ফিলিপাইন-ইন্দোনেশিয়ায় সুনামির আশঙ্কা কেটেছে, দেখা দিচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র Oct 10, 2025
img
শান্তি পরিকল্পনায় সাফল্যের জন্য ‘বন্ধু’ নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পকে মোদির অভিনন্দন Oct 10, 2025
img
২ হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিলেও ১ জনকে ছাড়বে না ইসরায়েল Oct 10, 2025
img
টুইঙ্কেল আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইত না: অক্ষয় Oct 10, 2025
img
বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ Oct 10, 2025
img
২০২৬ বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত করল ২০ দল Oct 10, 2025
img
চলচ্চিত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ পেয়েছেন তিনিও, স্বীকারোক্তি রণবীরের Oct 10, 2025
img
ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি শুরু! Oct 10, 2025
img
শান্তিতে নোবেল ঘোষণা আজ Oct 10, 2025
img
ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র Oct 10, 2025
img

নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ

৩ ম্যাচ হেরে জটিল সমীকরণে পাকিস্তানের সেমিফাইনাল আশা Oct 10, 2025
img
ট্রাম্পকে নোবেলের জন্য মনোনীত করবে ইউক্রেন Oct 10, 2025
img
সাবেক এমপি ইকবাল ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা Oct 10, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল রাবি শিক্ষকের, সহকর্মী আহত Oct 10, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঢাকায় Oct 10, 2025
img
দূষিত বাতাসের শীর্ষ শহর লাহোর, ১০ম অবস্থানে ঢাকা Oct 10, 2025
img
শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ Oct 10, 2025
img
জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতা Oct 10, 2025