ভবিষ্যতের খোঁজে বাংলাদেশ: তৈরি পোশাক ছাড়িয়ে বহুমুখী অর্থনীতি

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন পড়ানোর অভিজ্ঞতায় একটি উদ্বেগজনক চিত্র বারবার সামনে এসেছে। অনেক শিক্ষার্থী, যারা স্নাতক ডিগ্রির পথে রয়েছে বা স্নাতক সম্পন্ন করার মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে, কর্পোরেট দুনিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক দক্ষতাগুলো জানে না—যেমন, বাজেট তৈরি করা বা ইনকাম স্টেটমেন্ট কী, তা বোঝা।

এটি শুধু শ্রেণিকক্ষের পর্যবেক্ষণ নয়। শিল্প-খাতের পেশাজীবীরাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন—তাজা গ্র্যাজুয়েটরা বাস্তব জ্ঞান, মৌলিক দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্রের প্রস্তুতির অভাবে ভুগছে।

এই অভিযোগগুলো আমাদের কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে সামনে আনে, যা আমাদের প্রতিযোগিতামূলক ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। যদি আমরা আগামী দশকে টেকসই উন্নয়ন, অর্থনীতির বহুমুখীকরণ এবং জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, তাহলে এখনই কৌশলগতভাবে পথ পরিবর্তনের সময়।

আমরা যখন তারুণ্য-নেতৃত্বাধীন জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি, যা সংস্কারের বীজ বপন করেছিল, তখন আমাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত: রপ্তানিনির্ভরতা থেকে মুক্তি, মানবসম্পদে প্রকৃত বিনিয়োগ, এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় নীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

অতিমাত্রায় বলা হবে না যদি বলি, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে তৈরি পোশাক (RMG) খাতের সাফল্যের জোয়ারে ভেসেছে। এই খাত আমাদের মোট রপ্তানির ৮২-৮৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে।

যদিও এই নির্ভরতা আমাদের সৌভাগ্য এনেছে, এটি আমাদের অর্থনীতিকে এক ভয়ানক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যেভাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, তা আবারও প্রমাণ করে, একটি মাত্র খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের অর্থনীতিকে কতটা বিপদের মুখে ফেলতে পারে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র তার শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে, রপ্তানিকারকদের জন্য ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে। এই হার এখনো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি, যাদের পছন্দনীয় বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। রপ্তানি বাজারের বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এই সমস্ত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য আনয়ন এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি এবং সম্ভবত সবচেয়ে বাস্তবসম্মত কৌশল।

অনেক সম্ভাবনাময় খাত এখনো অনাবিষ্কৃত বা অপ্রচলিত। চামড়া শিল্প, যার বিশ্ববাজারে অংশীদারিত্ব ০.৫ শতাংশেরও কম, আমাদের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে রেখেছে—কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান দেশ। ফার্মাসিউটিক্যালস খাত, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বছরে ৪ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, আগামীতে আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়, আঞ্চলিক চাহিদা ও উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে।

তবে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক খাত হলো তথ্য ও প্রযুক্তি (আইটি) খাত। বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাজার আমাদের জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মাত্র ২-৫ শতাংশ বাজারও ধরতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয় ও প্রযুক্তিগত অবস্থানে বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ও ডিজিটাল সেবা আমাদের জন্য উচ্চমূল্যের রপ্তানির পথ খুলে দিতে পারে, যেটি কেবল উৎপাদন নয়, মেধাশক্তির ওপর নির্ভর করে।


আমাদের প্রচলিত খাতগুলোকেও অবহেলা করা চলবে না। মাছ ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত সঠিক বিনিয়োগ ও কৌশলগত অগ্রাধিকার পেলে আধুনিকায়ন করা সম্ভব। উদ্দেশ্য হলো, অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে দেওয়া—যাতে একটি খাতের বিশ্ববাজারে ওঠানামা আমাদের সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে বিপদে না ফেলে।

মানবসম্পদ গড়ে তোলা

বাংলাদেশ তার বর্তমান জনসংখ্যাগত সুবিধার সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী থাকলেও, এর বড় একটি অংশ এখনও দক্ষ নয় বা অদক্ষ। এই অপচয় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্ভাবনাকে ব্যাহত করে না, বরং জাতীয় প্রবৃদ্ধিকেও সীমিত করে।

এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের তরুণদের বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ চাকরির বাজারে নজর না দিয়ে, বৈশ্বিক চাহিদা ও সুযোগকে বিবেচনায় নিতে হবে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো—পাকিস্তান, ভারত, ও শ্রীলঙ্কা—তাদের নাগরিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে, কর্মজীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশকেও সেই পথে হাঁটতে হবে, তবে তা করতে হবে সুনির্দিষ্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে।

এ জন্য কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সরকারি ভর্তুকি অত্যাবশ্যক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, এবং নীতিনির্ধারকদের কৌশলগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান যেমন করেছে—শিক্ষা, নীতি এবং শিল্প উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে। টেক্সটাইল প্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও আইটি পরিষেবায় বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তা অর্জনে চাই সমন্বিত উদ্যোগ।

এই মনোভাব আমাদের অভিবাসন নীতিতেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। বর্তমানে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোয় অত্যন্ত নির্ভরশীল। এই পথ প্রায়ই পরিবারগুলোকে তাদের সঞ্চয় ব্যয় করতে বাধ্য করে, যার বিনিময়ে সীমিত আর্থিক লাভ হয়। এর বিপরীতে, দক্ষ শ্রমিকরা অনেক বেশি উপার্জন করে, সঞ্চয় করে এবং অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে সক্ষম হয়। দক্ষ পেশাজীবী রপ্তানিকে অগ্রাধিকার দিলে, বাংলাদেশ তার বার্ষিক রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি আনতে পারবে।
  


অর্থনৈতিক উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি হলেও, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত্তি। নীতির স্থিতিশীলতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। মোবাইল উৎপাদন শিল্পের অভিজ্ঞতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক পর্যায়ে ট্যাক্স ছাড় ও ইপিজেড-এর সুবিধা বিনিয়োগ টেনেছে, কিন্তু পরে নীতির অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তার সঙ্গে মানানসই ছিল না।

সম্প্রতি টাকা-মূল্য হ্রাস রাজনৈতিক অস্থিরতার ফল। টাকার বিনিময় হার ৮৫-৯০ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা ছাড়িয়ে এখন ১২০ টাকার আশেপাশে স্থিতিশীল হয়েছে—যার পেছনে মূলত বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক ও মূলধন অপসারণ দায়ী। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদী তহবিল বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল কাঠামো চায়।

স্থিতিশীল সরকারই নীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে, বিশেষত বিনিময় হার ও মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে। ‘ক্রলিং পেগ’ ব্যবস্থা বজায় রাখা হোক বা ফ্লোটিং রেট চালু করা হোক, নীতিগত সামঞ্জস্যই বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির পথ সুগম করে।

২০২৫ সালে আমরা একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি—এখান থেকে আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথ যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। আগামী দশক হতে পারে সবচেয়ে নির্ধারক মুহূর্ত—আমরা কি কেবল একক রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতিতে আটকে থাকব, না কি বহুমুখী, দৃঢ় অর্থনীতির দিকে এগোব? এই রূপান্তর অর্জনে চাই শিক্ষা, শিল্পায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন ও নীতির ধারাবাহিকতায় সম্মিলিত অগ্রগতি।

শিক্ষক হিসেবে আমাদের শেখানোর ধরন ও বিষয়বস্তু বদলাতে হবে।

লেখক: সাঈদ ইব্রাহিম আহমেদ: সহকারী অধ্যাপক, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পঞ্চগড়ে জেঁকে বসেছে শীতে, তাপমাত্রা নামল ১১ ডিগ্রিতে Dec 02, 2025
img
দুর্বল হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়াহ’ ,গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির আভাস Dec 02, 2025
img
ইমরান খানের খোঁজ না মেলায় পাকিস্তানজুড়ে উত্তেজনা, রাওয়ালপিন্ডিতে ১৪৪ ধারা জারি Dec 02, 2025
img
ভূমিকম্পের মাত্রা ছাড়াতে পারে ৭ দশমিক ৮-এর বেশি, এরপর আফটার শক! Dec 02, 2025
img
দেশে তৈরি হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ: মির্জা ফখরুল Dec 02, 2025
img
মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো টঙ্গীর ৫ দিনের জোড় ইজতেমা Dec 02, 2025
img
'এই দেশের মানুষকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না' Dec 02, 2025
img
আ’লী‌গ নেতাসহ পরিবারের সদস্যের ৬৬ কো‌টি টাকার সম্পত্তি ক্রোক Dec 02, 2025
img
৫ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার Dec 02, 2025
img
ভোট দিতে প্রবাসী নিবন্ধন ১ লাখ ২৭ হাজার Dec 02, 2025
img
স্বর্ণের ভরিতে বাড়ল ১৫৭৫ টাকা, আজ থেকে বিক্রি হবে নতুন দামে Dec 02, 2025
img
শান্তি আলোচনায় ভূখণ্ড ইস্যু সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ: জেলেনস্কি Dec 02, 2025
img
মধ্যপ্রাচ্যে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ চান পোপ Dec 02, 2025
img
১ কোটি টাকা লাগলেও মুশফিককে কিনত রাজশাহী Dec 02, 2025
img
নরেন্দ্র মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিএনপির Dec 02, 2025
img
'মা দুটো পথ দেখিয়েছিলেন - জনপ্রিয়তা ও প্রিয়জন' Dec 02, 2025
img
এইচআইভি মোকাবিলায় ৩ দেশে প্রথমবার একযোগে টিকাদান শুরু Dec 02, 2025
img
মেঘাচ্ছন্ন ঢাকার আকাশ, শুষ্ক থাকতে পারে আজকের আবহাওয়া Dec 02, 2025
img
বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন মাদার অব ডেমোক্রেসি ও আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক : ব্যারিস্টার মামুন Dec 02, 2025
img
নেতানিয়াহুকে আহমেদ আল-শারার সঙ্গে দৃঢ় সংলাপ বজায় রাখার তাগিদ ট্রাম্পের Dec 02, 2025