আলোচিত সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর লুটপাট ও আর্থিক দুর্নীতির ঘটনায় রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অভিযানে প্রাথমিক সত্যতা মেলায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। অনুসন্ধান পর্যায়ে অপরাধের মাত্রা ও সংশ্লিষ্টতার ধরন বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত মঙ্গলবার কমিশনের সভায় এই প্রস্তাব তোলা হলে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে দুদকের সিলেট কার্যালয় থেকে পরিচালিত অভিযানে ৪২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থার নাম উঠে আসে। শিগগিরই অনুসন্ধান টিম গঠন করা হবে বলে জানা গেছে।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে সাদা পাথর নামে একটি পর্যটনকেন্দ্র অবস্থিত। পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে গত তিন মাস ধরে এখানে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন চলছে। পর্যটন এলাকাটি সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৮০ ভাগ পাথর তুলে নেওয়ায় পুরো এলাকাটি অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে।
গত ১৩ আগস্ট দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে। তারা পাথর লুটের ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়। অভিযানে দুদকের দল দেখতে পায়, স্থানীয় প্রশাসনের পর্যটন সেবা এবং নদীর তীরেই বিজিবি ক্যাম্পের টহল চালু থাকা সত্ত্বেও বিগত কয়েক মাসে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
দুদকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে পাথরলুট কাণ্ডে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, সদস্য মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।
তালিকায় আরও রয়েছে আওয়ামী লীগের সাত নেতাকর্মীর নাম। তারা হলেন- কার্যক্রম নিষিদ্ধ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, কর্মী মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান।
প্রতিবেদনে জামায়াতের দুজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। প্রতিবেদনে এনসিপির দুই নেতার নাম এসেছে। এরা হলেন- সিলেট জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
এ ছাড়া অনুসন্ধানে সাদা পাথর লুটের সঙ্গে আরও ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জের আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম ও মুকাররিম আহমেদ।
অন্যদিকে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে দায়ী করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজিজুন্নাহার, কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, ঊর্মি রায়, আবিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। এছাড়া বর্ডার গার্ডকেও দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কেএন/টিকে