স্বজনহারাদের কান্নায় কেটেছে গেল বছরটি। করোনার কবলে বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। আমরা হারিয়েছি বেশ কয়েকজন শীর্ষ শিল্পপতিকে। এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল, মোনেম গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মোনেম খান, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, চা শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী আজমত মঈন, এস আলম গ্রুপ ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদুল আলমের মৃত্যুতে শিল্পখাতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বছরের শেষ সময়ে দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাসেম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সব মিলিয়ে করোনাকালে ২০২০ সালে (এপ্রিল-ডিসেম্বর ২০২০) মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে দেশে ৩৫ জন শিল্পপতির মৃত্যু হয়েছে।
নুরুল ইসলাম বাবুল : যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে ১৫ জুন। করোনায় তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৩ জুলাই ৭৪ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টার যমুনা ফিউচার পার্কের মালিক। যুগান্তর ও যমুনা টিভিসহ ৪১ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন।
লতিফুর রহমান : লতিফুর রহমান প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার অন্যতম মালিক। এছাড়া, আন্তর্জাতিক ফুড চেইন পিৎজা হাট ও কেএফসি, পেপসি এবং ফিলিপসের বাংলাদেশের ফ্রাঞ্চাইজের মালিক ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ওষুধ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, চা শিল্প, নেসলে বাংলাদেশ, হোলসিম বাংলাদেশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমাসহ একাধিক কোম্পানির প্রধান ছিলেন। গত বছরের ০১ জুলাই মারা যান। করোনাকালে তিনি তার গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করেছেন। তবে করোনা নয় বার্ধক্যজনিত কারণেই তিনি মারা গেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই ফুসফুসের সমস্যা ছিল লতিফুর রহমানের। বার্ধক্যজনিত আরও কিছু জটিলতায় তিনি ভুগছিলেন।
এম এ হাসেম : দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাসেম করোনায় আক্রান্ত হয়ে বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১টা ২০ মিনিটে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর কারোনা শনাক্ত হওয়ার পর এম এ হাসেমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৬ ডিসেম্বর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল।
আবদুল মোনেম খান : বিশিষ্ট শিল্পপতি ও আবদুল মোনেম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মোনেম খান বিদায় নেন এই বছর। ৩১ মে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্ট্রোক করেছিলেন।
মোরশেদুল আলম : করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন এস আলম গ্রুপ ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক মোরশেদুল আলম। তিনি এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেমন ইস্পাত লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ৬৫ বছর বয়সে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ২২ মে তিনি মারা যান।
আজমত মঈন : করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭ জুন চা শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী আজমত মঈন মারা যান। তিনি ছিলেন মৌলভী চা কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সুরমা চা কোম্পানির পরিচালক। এছাড়া তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নবাব মোশারফ হোসেনের প্রপৌত্র।
আলী যাকের : তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন সফল ব্যবসায়ী। দেশের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির কর্ণধার ছিলেন তিনি। গত ২৩ নভেম্বর তার করোনা পজিটিভ আসে। গত ২৭ নভেম্বর ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তাহেরা খানম : বেসকারি হাসপাতাল পপুলারের চেয়ারপারসন তাহেরা খানম ১০ জুন মারা যান। তার করোনা পজিটিভ থাকলেও হৃদরোগের কারণে তিনি ঢাকার অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
হাজী মকবুল : গত ২৪ মে রাতে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাজী মকবুল। এ রাজনীতিবিদ ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য। তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা। তাছাড়া তিনি মোহাম্মদপুরে নিজের নামে একটি কলেজসহ গড়ে তুলেছেন আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া তার মালিকানায় রয়েছে এ্যমিকো ল্যাবরেটরিজ, পান্না টেক্সটাইল, মোনা ফিন্যান্সসহ কয়েকটি কোম্পানি। তার ছেলে আহসানুল ইসলাম টিটু টাঙ্গাইল-৬ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
জামিল সাত্তার : ২৫ জুন মারা যান শিল্পপতি হাসান জামিল সাত্তার। তিনি ছিলেন ময়নামতি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
শেখ মোমিন উদ্দিন : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনের মেজো ছেলে ও আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের পরিচালক শেখ মোমিন উদ্দিন মারা যান গত ২৪ আগস্ট। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
হাসান মাহমুদ চৌধুরী : করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চট্টগ্রামের আরেক শিল্পপতি হাসান মাহমুদ চৌধুরী। ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তিনি লাতিন আমেরিকা বাংলাদেশ চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও থাই চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ইমামুল কবির শান্ত : শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্ণধার মো. ইমামুল কবির শান্ত মারা গেছেন ৩০ মে। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি এবং এফবিসিসিআই সাবেক সদস্য তিনি।
এছাড়া বাংলাদেশ হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সদস্য সাদিক আহসান, বাংলাদেশ প্লাস্টিক রাবার সু মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও সাবেক এফবিসিসিআই সদস্য মো. মনসুর আলী, পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল ফেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন মাহমুদ, বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিরাজ উদ্দিন দেওয়ান, বাংলাদেশ পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম, এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী সানবিম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুর, বাংলাদেশ ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও সাবেক এফবিসিসিআই পর্ষদ সদস্য আবু বকর সিদ্দিক, বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ, ন্যাশনাল কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. কামরুল হুসেন চৌধুরী (গোর্কি), বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, রয়েল ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী বদরুল হুদা মুকুল, এফবিসিসিআইয়ের সদস্য মো. হাবিবুল্লাহ ও বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সদস্য মো. বাচ্চু মিঞা ও বাংলাদেশ মেটাল ওয়্যার অ্যান্ড ওয়্যারনেইলস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সহ-সভাপতি মো. মোবারক হোসেন, এনএফকে টেক্সটাইলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, পার্ল প্রিনস বিডি লিমিটেডের চেয়ারম্যান তসলিম আক্তার, ইস্ট ওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ, রহমত গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার মারা গেছেন করোনাকালে।
টাইমস/জেকে