আবরারকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ইফতি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। গত ৫ অক্টোবর বিকালে ৫টা ৩২ মিনিটে ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তি নিয়ে আবরার ফাহাদ ফেসবুক সর্বশেষ স্ট্যাটাস দেন। তখন তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ায় বাড়িতে। পরদিন রোববার বিকালে তিনি বাড়ি থেকে বুয়েটের হলে ফেরেন।

হলে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত আটটার দিকে আবরারকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। ক্রিকেটের স্টাম্প আর প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ) দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। তাকে মাটি থেকে তুলে আবারও পেটাতে থাকেন তারা। ঘণ্টা কয়েক পর বমি করতে শুরু করেন আবরার। তিনবার বমি করার পর নিস্তেজ হয়ে যান।

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকালের কক্ষেই ঘটে এ ঘটনা। বৃহস্পতিবার বিকালে মহানগর হাকিম খন্দকার ইয়াসির আহসান চৌধুরীর কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন ইফতি। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন তিনি।

আবরার হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ইফতিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। ইফতিই আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে আনা থেকে শুরু করে পুরো হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।

আবরারকে হত্যা করার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন ইফতি

৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’

৬ অক্টোবর রাত আটটার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে আনা হয়। তার রুমমেট বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল ফোন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল ফোন চেক করেন। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি আবরারের কাছ থেকে তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুলে চেক করেন।

আবরারের ডিভাইসগুলো তারা যখন চেক করছিলেন, তখন মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) কক্ষে আসেন। মেহেদী তাদের বুয়েটে কারা কারা শিবির করে তা আবরারের কাছ থেকে বের করার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় মেহেদী বেশ কয়েকটি চড় মারেন আবরারকে।

ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে তখন কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে তার হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন। এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারেন।

রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তার মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান।

তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখন আবরারের মাথার নিচে দুটি বালিশ দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করেন। মুঠোফোনে বিষয়টি অনিককে জানানো হলে তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তার কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদী আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও নাটক করছে’।

এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সবকিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে তারা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তারা চলে যান।

এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে তার খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ পরে ইফতি একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আসিফ ও মাহফুজ এনসিপিতে যুক্ত হতে চাইলে সাদরে গ্রহণ করবো : আখতার Dec 11, 2025
img
বেগম খালেদা জিয়া বেঁচে থাকা মানে গণতন্ত্রের ভীত শক্তিশালী থাকা: এ্যানি Dec 11, 2025
img
১৪৫ ভরি স্বর্ণ লুটের ঘটনায় পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ আটক ৫ Dec 11, 2025
img
নারায়ণগঞ্জে দুর্বৃত্তদের হামলায় এনসিপির ৩ কর্মী আহত Dec 11, 2025
img
পোশাক থেকে কুটিরশিল্প, দেশ ৬০% উৎপাদন সক্ষমতা ফিরে পেয়েছে : এম সাখাওয়াত হোসেন Dec 11, 2025
img
জাতীয় পোস্টাল ব্যালট অ্যাপে প্রবাসীদের নিবন্ধন ছাড়ালো ৩ লাখ Dec 11, 2025
img
আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সদর দপ্তরে পুলিশের অভিযান! Dec 11, 2025
img
বেগম রোকেয়া নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য সরিয়ে নিলেন রাবি শিক্ষক, কারণও ব্যাখ্যা করলেন Dec 11, 2025
img
এ মাসেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান: ইশরাক হোসেন Dec 11, 2025
img
অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ার্ক-হলিডে ভিসা পুনরায় চালু করতে আহ্বান বাংলাদেশের Dec 11, 2025
img
কঠোর হচ্ছে ইউরোপের অভিবাসন নীতি Dec 11, 2025
img

কক্সবাজার-১ আসন

সালাহউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বি হলেন তারই শিক্ষক অধ্যাপক মাইমুল Dec 11, 2025
img

হান্নান মাসউদ

ইউনূস স্যারকে দিয়ে হাতিয়ার ব্লকবাঁধের জন্য ২১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়েছি Dec 11, 2025
img
বাংলাদেশের বাজেটের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধে : বিডা চেয়ারম্যান Dec 11, 2025
img
১২ ডিসেম্বর থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা ডিএমটিসিএলের কর্মচারীদের Dec 11, 2025
img
অর্থ পাচারের বিষয়ে সায়মন ওভারসীজের কাছে ব্যাখ্যা চাইল মন্ত্রণালয় Dec 11, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতা শোয়াইব হোসেন আটক Dec 11, 2025
img
দলে দলে লড়াই নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাতিয়া বদলাই: হান্নান মাসউদ Dec 11, 2025
img
আসন্ন নির্বাচনে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ভোট হবে : শামা ওবায়েদ Dec 11, 2025
img
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পেলেন আমিরুল Dec 11, 2025