জবানবন্দিতে যেসব ভয়াবহ তথ্য দিয়েছিল মিন্নি

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার চার্জশিট এক সেপ্টেম্বর আদালতে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বরগুনা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ূন কবির।

আদালতে চার্জশিট দাখিল করলেও মামলার আসামিপক্ষ অথবা গণমাধ্যমকর্মীরা চার্জশিটের কপি এতদিন হাতে পায়নি। ১৮ সেপ্টেম্বর চার্জশিট আদালত গ্রহণ করার পর বৃহস্পতিবার কপি বাহিরে প্রকাশ হয়েছে।

আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহাবুবুল বারী আসলামের কাছ থেকে চার্জশিটের কপি পাওয়া গেছে।

রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া মিন্নির সেই স্বীকারোক্তি হুবহু বাংলাদেশ টাইমসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

আমি মিন্নি বরগুনা সরকারি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করি। ২০১৮ সালে বরগুনা আইডিয়াল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করি। আইডিয়াল কলেজে পড়ার সময় ২০১৭ সালে আমার ও রিফাতের প্রেমের সম্পর্ক হয়। ওই সময় রিফাত শরীফ বামনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিল।

রিফাত শরীফ আমাকে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করে দেয় তার মধ্যে নয়ন বন্ড একজন। কলেজে যাওয়া-আসার পথে নয়ন বন্ড আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করতো। আমি তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় সে আমার বাবা ও ছোট ভাইকে ক্ষতি করার ভয় দেখাত। বিষয়টি আমি রিফাত শরীফকে জানাইনি।

আমি রিফাত শরীফকে ভালোবাসতাম। কিন্তু রিফাত শরীফ অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করার কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করি এবং এ কারণে রিফাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে এবং আমি ধীরে ধীরে নয়ন বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আমি নয়নের মোবাইল নম্বরে আমার মায়ের মোবাইল নম্বর এবং নয়নের দেয়া নম্বর শেষে ৬১১৩ ও একটি নম্বর শেষে ৪৫ দিয়ে নয়নকে কল, ম্যাসেজ এবং ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কল দিতাম। বরগুনা সরকারি কলেজে পড়াকালীন ধীরে ধীরে রিফাত ফরাজী, রিফাত হাওলাদার ও রাব্বি আকনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রেমের সম্পর্কের কারণে নয়ন বন্ডের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। নয়নের বাসায় দুজনের শারীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি ও ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি প্রথমে জানতাম না।

এরপর গত ১৫/১০/১৮ আমি রোজী অ্যান্টির বাসায় যাওয়ার পথে বিকেল বেলা ব্যাংক কলোনি থেকে নয়ন বন্ড রিকশাযোগে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।

নয়নের বাসায় গিয়ে আমি শাওন, রাজু, রিফাত ফরাজী এবং আরও ৭/৮ জনকে দেখি। শাওন বাইরে গিয়ে কাজী ডেকে আনে এবং নয়নের বাসায় আমার ও নয়নের বিয়ে হয়। তারপর আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে নয়নকে ফোন করে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলি। তখন নয়ন বলে- ওইটা বালামে ওঠে নাই। বালামে না ওঠলে বিয়ে হয় না।

এরপরও আমি নয়নের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখি। নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবারের কেউ জানে না। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস আমি মিস করি। তখন নয়নের মোটরসাইকেলে আমি কুয়াকাটা যাই এবং নয়নের সঙ্গে একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করি।

আমি নয়নের বাসায় আসা-যাওয়া সময় জানতে পারি নয়ন মাদকসেবী, ছিনতাই করে এবং তার নামে থানায় অনেক মামলা আছে। এ কারণে নয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয় এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার পূর্বের ভালোবাসার সম্পর্ক আবার শুরু হয়। গত ২৬ এপ্রিল পারিবারিকভাবে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ শারীরিক সম্পর্ক, মোবাইলে কথা-বার্তা, ম্যাসেজ এবং ফেসবুকের মেসেঞ্জারে যোগাযোগ- সবই চলতো।

বিয়ের পর জানতে পারি রিফাত শরীফও মাদকসেবী। সে মাদকসহ পুলিশের কাছে ধরা খায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমি রিফাতসহ আমার বাবার বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতাম। নয়ন বন্ডের বিষয় নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হতো এবং রিফাত শরীফ আমার গায়ে হাত তুলতো।

গত ২৪ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দিয়ে বলে, তোর স্বামী, হেলালের ফোন ছিনাইয়া নিয়েছে। পরে রিফাত ফরাজীও আমাকে ফোন দিয়ে বলে, হেলালের মোবাইলটি রিফাতের কাছ থেকে নিয়ে হেলালকে ফেরত দিতে। আমি রিফাত শরীফকে হেলালের ফোন ফেরত দিতে বললে রিফাত শরীফ আমাকে চড় থাপ্পড় মারে এবং তলপেটে লাথি মারে। রাতে মোবাইল ফোনে নয়নকে জানাই এবং কান্না করি।

পরদিন ২৫ এপ্রিল আমি কলেজে গিয়ে নয়নের বাসায় যাই। রিফাত শরীফকে একটা শিক্ষা দিতে হবে এ কথা নয়নকে বললে নয়ন বলে, হেলালের ফোন নিয়ে যে ঘটনা তাতে রিফাত ফরাজী তাকে মারবে। তারপর আমি বাসায় চলে আসি এবং এ বিষয়ে কয়েক বার আমার নয়ন বন্ডের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার স্বামী রিফাত শরীফকে মাইর দিয়া শিক্ষা দিতে হবে, এ পরিকল্পনা করি।

২৬ এপ্রিল আমি কলেজে যাই এবং সায়েন্স বিল্ডিং এর পাশের বেঞ্চের উপর রিফাত ফরাজী রাব্বি আকনকে বসা পাই। রিফাত হাওলাদার পাশে দাঁড়ানো ছিল। তখন আমি রিফাত ফরাজীর পাশে বসি এবং রিফাত ফরাজীকে বলি, ওকি ভাইটু খালী হাতে আসছ কেন, এ কথার জবাবে রিফাত হাওলাদার বলে, ওকে মারার জন্য খালি হাত যথেষ্ট।

এরপর রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসা করি, নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ কলেজে এসেছে কিনা? তখন নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দেয়। সে কোথায় জানতে চাইলে নতুন ভবনের দিকে যেতে বলে এবং ওই সময় নয়ন নতুন ভবনের পাশের দেয়াল টপকিয়ে ভেতরে আসে। আমি হেঁটে নতুন ভবনের দিকে যাই এবং নয়নের সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারপিটের বিষয়ে কথা বলি। এরপর রিফাত শরীফ কলেজের ভেতরে আসে এবং আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলের কাছে নিয়ে আসে।

কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে না উঠে সময় ক্ষেপণ করার জন্য পুনরায় কলেজ গেটে ফিরে আসি। রিফাত শরীফ আমার পেছন পেছন ফিরে আসে। তখন রিশান ফরাজী কিছু পোলাপানসহ আসে এবং রিশান ফরাজী জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছ কেন? রিফাত শরীফ বলে, আমি গালি দেই নাই।

ওই সময় রিফাত ফরাজী (রিফাত শরীফের) জামার কলার ধরে এবং রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে। রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়, রিশান ফরাজীসহ রিফাত হাওলাদার এবং আরও অনেকে রিফাত শরীফকে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মারধর করতে করতে এবং টেনে হেঁচড়ে ক্যালিক্সের দিকে নিয়ে যায়।

ক্যালিক্সের সামনে তারা রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। আমি তখন সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় নয়ন বন্ড ক্যালিক্সের সামনে এসে রিফাত শরীফকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। মারপিটের মধ্যেই রিফাত ফরাজী টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে যায় এবং রিফাত ফরাজী দুটি দা ও টিকটক হৃদয় এবং রিফাত হাওলাদার লাঠি নিয়ে আসে।

একটি দা দিয়ে নয়ন বন্ড ও ১টি দা দিয়ে রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে কোপাচ্ছিল। রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখে যাতে রিফাত শরীফ পালাতে না পারে। রিফাত শরীফকে কোপাইতে দেখে আমি নয়ন বন্ডকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। দায়ের কোপের আঘাতে রিফাত শরীফ রক্তাক্ত হয়।

সে (রিফাত শরীফ) রক্তাক্ত অবস্থায় পূর্ব দিকে হেঁটে যায় এবং আমি রাস্তায় পড়ে থাকা জুতা পরি এবং উপস্থিত একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দিলে আমি রিকশা করে তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি।

এরপর আমার বাবাকে ফোন করি। আমার বাবা ও চাচা হাসপাতালে আসে। এরপর রিফাত শরীফকে বরিশাল পাঠানো হয়। আমার কাপড়-চোপড়ের রক্ত লেগে থাকায় আমি বাসায় চলে যাই। পরে আমি জানতে পারি রিফাতের অবস্থা খারাপ।

এরপর নয়নকে ফোনে বলি তোমরা ওকে যেভাবে কোপাইছো তাতে তো ও মারা যাবে এবং তুমি আসামি হবা। তারপর ওর অবস্থান জানতে চাই এবং পালাতে বলি। দুপুরের পর খবর পাই রিফাত শরীফ মারা গেছে।

 

টাইমস/এএইচ/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি খালেদা জিয়ার দল, তারেক রহমানের দল: রুমিন ফারহানা Jul 19, 2025
img
তদবির নয়, এবার বিচারপতি নিয়োগে কাঠামোগত পরিবর্তন Jul 19, 2025
img
সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে উইমেন্স ইউরোর সেমিফাইনালে স্পেন Jul 19, 2025
img
ড্রোন ও এআই অস্ত্র নির্মাণে যৌথভাবে কাজ করবে যুক্তরাজ্য-জার্মানি Jul 19, 2025
img
স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধে স্নান করলেন হৃদয় মিয়া Jul 19, 2025
img
হাই অল্টিটিউড ম্যাচে কতটা প্রস্তুত জামালরা? Jul 19, 2025
img
সমর্থক গ্রেফতারে শীর্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড Jul 19, 2025
img
সরকারই উসকানি দিয়ে এনসিপিকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়েছে : এলডিপি মহাসচিব Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশ সরকারের কাজের প্রশংসা করলেন স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট Jul 19, 2025
img
কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের লোক ছাত্রদের দল গঠনের বুদ্ধি দিয়েছে : অলি আহমদ Jul 19, 2025
img
পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায় না বিএনপি Jul 19, 2025
হলফনামায় শেখ হাসিনার মি'থ্যা তথ্য, ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই ইসির Jul 19, 2025
img
মুজিববাদের কবর দিতে গোপালগঞ্জ যাওয়ার দরকার নেই : এ্যানি Jul 19, 2025
বাংলাদেশে স্টারলিংক কার্যক্রমে সরকারকে ‘নজিরবিহীন’ বললো স্পেসএক্স Jul 19, 2025
‘হিরোস উইদাউট কেপস’ ডকুমেন্টারি: জুলাই আন্দোলনের প্রামাণ্য চিত্র Jul 19, 2025
img
জামালপুরে যুব মহিলা লীগ নেত্রী গ্রেফতার Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশে স্টারলিংক আনুষ্ঠানিকভাবে চালু, রিসেলার বিএসসিএল Jul 19, 2025
img
দলীয় উন্নয়নেই মনোযোগ, আজও দ্বিতীয় সারির দল পাঠাবেন বাটলার Jul 19, 2025
img
পাকিস্তানের ইরানি দূত এখন এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড Jul 19, 2025
img
এসি মিলানে মডরিচ, ফিরে গেলেন ছোটবেলার প্রেমে Jul 19, 2025