সৌন্দর্যের লীলাভূমি লোভাছড়া

চারদিকে সবুজ বেষ্টিত চা-বাগান, সারি সারি গাছ, পাহাড়, মেঘ আর বালুসমৃদ্ধ স্বচ্ছ নদীর পানির সঙ্গে নীল আকাশের মিতালি। স্রোতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। স্বচ্ছ নীলাকাশে সাদা বক আর বিভিন্ন পাখির ওড়া-উড়ি। বড় বড় সবুজ পাহাড় ছুঁয়ে নেমেছে ঝর্ণা। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অনন্য রূপ হচ্ছে লোভাছড়া।

লোভাছড়া সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নে অবস্থিত এক মনোমুগ্ধকর স্থান। মূলত লোভাছড়া চা বাগান'ই নাম এটির। আর এই চা বাগানের সূত্র ধরেই পুরো গোটা একটা বিশাল এলাকার নাম হয়েছে লোভাছড়া। এখানে রয়েছে ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া চা বাগান এবং নানা দর্শনীয় স্থান।

লোভাছড়া থেকে ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয় খুব বেশী দূরে নয়। এখানকার যে কোন উঁচু পাহাড়ে উঠলে মেঘালয়ের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় খুব কাছে থেকে দেখা যায়। লোভাছড়ার বাড়তি আকর্ষণ ‘খাসিয়া পুঞ্জি’। এখানকার খাসিয়াদেরও আদি নিবাস ছিল খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়। বহু বছর পূর্ব থেকে এদের লোভাছড়ায় বসবাস।

লোভাছড়া থেকে ৫ কি. মি উত্তরে গভীর জঙ্গলের ভিতরে কয়েকটি বিশাল আকৃতি পাথর রয়েছে। এক একটি পাথরের উচ্চতা হবে প্রায় ৩০ ফুট। প্রতিটি পাথর গোলাকার। চওড়া হবে প্রায় ৫০ ফুট। এই পাথরগুলোর অবস্থান পাহাড়ের নিচে। এসব পাথরে বসে রাজা-রানিরা খেলতেন। পাথরে বসে রাজা-রানিরা লোভাছড়ার সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে অবলোকন করতেন।

এখানে রয়েছে বিশাল আয়তনের একটি চা বাগান। যা লোভাছড়া টি এস্টেট নামে পরিচিত। লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত লোভাছড়া নদীর পাশেই ব্রিটিশ আমলে প্রায় ১৮৩৯ একর জমির উপর গড়ে ওঠে লোভাছড়া চা-বাগান। বাগানের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের একটি পিকনিক স্পট ও লালাখাল চা-বাগান অবস্থিত। ভোরবেলায় লোভাছড়া বাগানে হরিণ, খরগোশ, আর বন মোরগ চোখে পড়ে। লোভাছড়া চা বাগানটি বন্যপ্রাণীরও অভয়াশ্রম। বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লোভাছড়া নদী। এই নদীতে নৌকায় চড়ে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক লোভাছড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে। এছাড়া এখানে দেখা যায় শ্রমিকদের পাথর উত্তোলনের দৃশ্য।

চা বাগানের পাশেই রয়েছে বিশাল এক দীঘি। এই দীঘিতে এককালে বিভিন্ন অলৌকিক জিনিসপত্র যেমন তালা-বাসন, রৌপ্যমুদ্রা ইত্যাদি ভেসে উঠতো বলে লোকমুখে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সুরমা নদীর পূর্ব প্রান্তজুড়ে রয়েছে সুবিশাল পাথরের খনি। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে। এখান থেকে আহরিত পাথর সারা দেশে সরবরাহ করা হয়।

এখানকার কোয়ারিতে আসার পথে আকর্ষণীয় অনেক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। নৌকায় আরোহণ করার পর পাহাড়, বাগান আর সবুজ বনানী নৌকা আরোহীর দৃষ্টি ও মন কেড়ে নেয়। নৌকায় বসে স্বচ্ছ পানির নিচ দিয়ে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়।

লোভাছড়ার পাশেই রয়েছে সুরমা, লোভা ও বরাক নদীর মিলনস্থল। তিনটি নদীর মিলন এখানে বদ্বীপের সৃষ্টি করেছে। নদীগুলোর মিলনস্থলে নদীর এক পাশের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং অপর পাশের পানি খুবই ঘোলা। একই নদীতে দুই ধরনের পানি দেখে অনেকেই পুলকিত হন।

লোভাছড়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঝুলন্ত সেতু। সড়ক পথে লোভাছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু, স্থানীয়ভাবে যা ‘লটকনির পুল’ নামে পরিচিত। জানা যায়, ১৯২৫ সালে ইংরেজরা লোভাছড়ায় যাতায়াতের জন্য সেতুটি নির্মাণ করে। আকর্ষণীয় এই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লোভাছড়ার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা সত্যিই অসাধারণ। লোভাছড়ার দক্ষিণ পাশে সুরমা নদী তীরবর্তী মূলাগুল বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত একটি টিলার ওপর রয়েছে হযরত শাহজালাল(র.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম ওলি হযরত মীরাপিং শাহ (র.) এর মাজার। মাজারটি দেখার জন্য এখানে প্রতিদিন অনেক ভক্ত এসে ভিড় জমান। ভক্তদের ভালোবাসার শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে মাজার সংলগ্ন এলাকায়।

কখন যাবেন:
লোভাছড়া কখন যাবেন চাইলে যেকোনো মৌসুমে আপনি লোভাছড়া ঘুরতে পারেন। তবে পুরোটাই সবুজময় লোভাছড়া চা বাগান বর্ষায় এক অপূর্ব রূপ ধারণ করে। বৃষ্টির দিনে লোভাছড়ার সবুজ বুকে ঝাঁপ দেওয়া কিংবা শীতে এপাশ-ওপাশ কুয়াশাময় পাহাড় আর বাগানে রোদের খেলা যেকোনো পর্যটকের হৃদয় জয় করবে।

যাওয়ার উপায়:

বাস: ঢাকা থেকে সিলেট এর উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায় গাবতলি এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে। বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ছেড়ে যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রিন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ও এনা পরিবহনের বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার ১শ’ টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।

ট্রেনে: ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।

আকাশপথে: ঢাকা থেকে বিমানযোগেও সিলেট যেতে পারেন। এজন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউএস বাংলা এয়ার, নভো এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, রিসেন্ট এয়ারের বিমানে করে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে।

সিলেট থেকে লোভাছড়া:

সিলেট শহর থেকে তিনটি সড়কে কানাইঘাট সদরে পৌঁছার সুযোগ আছে। বাস অথবা সিএনজি-অটোরিক্সায় সরাসরি দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদরে যাওয়া যায়। অন্যদিকে, গোলাপগঞ্জ-চারখাই-শাহবাগ হয়ে জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে কানাইঘাট পৌঁছা যাবে। এছাড়া গাজী বুরহান উদ্দিন সড়ক দিয়ে সিলেট-গাছবাড়ী সড়ক দিয়ে কানাইঘাট সদরে পৌছার সুযোগ রয়েছে। সিলেট শহর থেকে কানাইঘাট সদরে বাসভাড়া সর্বোচ্চ ৬০টাকা এবং সিএনজি-অটোরিকশা ভাড়া সর্বোচ্চ ১শ’ টাকা।

রিজার্ভ সিএনজি ৫শ’ ৭শ’ টাকা নিবে। তিন পথেই সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে কানাইঘাটে। কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে লোভাছড়ার দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার। উপজেলা সদর থেকে সড়ক ও নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়া যায়। লোভাছড়ায় যাতায়াতের রাস্তাটির অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাঁচা হওয়ায় খুবই কষ্ট করে সেখানে পৌঁছাতে হয়। তাই নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়াই সহজ রাস্তা। আর লোভাছড়া ঘুরতে সময় লাগবে প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা।

কোথায় থাকবেন:

থাকার জন্য আপনাকে সিলেট শহরে ফিরে আসতে হবে। সিলেটে থাকার মত অনেকগুলো আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট আছে। আপনি আপনার প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনো ধরনের হোটেল পাবেন। তাদের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে।

শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯)।

দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫)।

ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭)।

বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩)।

নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)।

জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)।

লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)।

আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)।

দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)।

হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)।

জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০)।

তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি।

এছাড়া আরও কয়েকটি হোটেল হল - হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেইট, সুরমা,কায়কোবাদ ইত্যাদি। লালা বাজার এলাকায় কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত রেস্ট হাউস আছে। হোটেল অনুরাগ - এ সিঙ্গেল রুম ৪০০ টাকা (দুই জন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০টাকা (নরমালই ৪জন থাকতে পারবেন)। রাত যাপনের জন্য দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০- টাকা থেকে ৫০০০- টাকা পর্যন্ত।

কোথায় খাবেন:

খাওয়ার জন্য সিলেটে বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী একটিতে খেয়ে নিতে পারেন।

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
এক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষণা হবে সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন কাঠামো : তথ্য উপদেষ্টা Oct 26, 2025
img
পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই, তবে ভারতের সঙ্গে খারাপ করে নয় : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী Oct 26, 2025
img
জুলাই সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার ঐতিহাসিক দলিল : সালাহউদ্দিন Oct 26, 2025
img
অবহেলায় মেরে ফেলা হলো জুবিনকে: গরিমা শইকীয়া Oct 26, 2025
img
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ নেই : আমির খসরু Oct 26, 2025
আরপিওর ২০ ধারায় পরিবর্তন: ইসিকে বিএনপির চিঠি Oct 26, 2025
img
মিরপুরে আগুনের ১২ দিন পর আরও এক নারীর মরদেহ উদ্ধার Oct 26, 2025
img
চাকরিপ্রার্থী নয়, চাকরিদাতা হয়ে উঠুক তরুণরা : শিক্ষা উপদেষ্টা Oct 26, 2025
img
ট্রাম্পের ‘সময় নষ্ট’ মন্তব্যে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া Oct 26, 2025
img
পাকা কলা ঘুষ খাওয়ায় জেলা পরিষদ কর্মকর্তাকে বদলি Oct 26, 2025
সূরা ফাতিহার ফজিলত | ইসলামিক জ্ঞান Oct 26, 2025
নাগরিক সমাবেশে যা বললেন শামসুজ্জামান দুদু Oct 26, 2025
নুরকে নিয়ে স্মৃতিচারণে যা বললেন বিএনপি নেতা আলাল Oct 26, 2025
দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে কুমিল্লা নগরীর কান্দিখাল Oct 26, 2025
img

শাকিব খান

আপনি নিজেকে যত বেশি জানবেন, তত কম ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হবে Oct 26, 2025
img

সারজিস আলম

আমরা জাতীয় পার্টির মতো পোষা রাজনৈতিক দল হতে আসি নাই Oct 26, 2025
img
ভারতকে ১২৬ রানের লক্ষ্য দিলো বাংলাদেশ Oct 26, 2025
img
জাকের পার্টির পতাকাতলে দেশবাসী নিরাপদ : আমীর ফয়সাল Oct 26, 2025
img

এনবিআর

বেনাপোল স্থলবন্দরে আগের নিয়মে আমদানি-রপ্তানি Oct 26, 2025
img
রোহিত-বিরাটের সমালোচকদের উদ্দ্যেশে সুনীল শেট্টির কড়া বার্তা Oct 26, 2025