এরদোগান : সবজি বিক্রেতা থেকে প্রেসিডেন্ট

রিসেপ তায়েপ এরদোগান। তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট। এছাড়া বর্তমান মুসলিম বিশ্বের শীর্ষনেতাদের অন্যতম জনপ্রিয় একজন। তার নেতৃত্বেই মুসলিম বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে তুরস্ক। এরদোগান ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন তুরস্কের কোস্টগার্ডের একজন সদস্য। মধ্যবিত্ত এই পরিবারে কিছু বাড়তি আয় যোগানের জন্য শৈশবে ফুটপাতে সবজি বিক্রির কাজ করতেন এরদোগান।

এরদোগান ফুটবল খেলায় খুব পারদর্শী ছিলেন। শৈশবে তুরস্কের অনেক নামী-দামী ক্লাবে ফুটবল খেলেছেন। কিন্তু পেশা হিসেবে ফুটবল খেলার প্রতি তার বাবার সমর্থন ছিল না। তাই তার বাবা এরদোগানকে ইস্তাম্বুল ইমাম হাতিপ স্কুলে ভর্তি করেন। সেখানে তিনি ন্যাশনাল তার্কিশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে তিনি ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৭৬ সালে এই দলের ইস্তাম্বুল যুব শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে সেনা অভ্যুত্থানের ফলে এই দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৯৮১ সালে তিনি মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও প্রশাসন অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর একটি প্রাইভেট কোম্পানীর ম্যানেজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে ওয়েলফেয়ার পার্টির মাধ্যমে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসেন এরদোগান। ১৯৮৪ সালে তিনি এই দলের বেইয়োগ্লু জেলার প্রধান নির্বাচিত হন।

১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম ইসলামপন্থী হিসেবে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি ইস্তাম্বুল শহরে অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ করেন। এসময় ইস্তাম্বুলে খাবার পানির সংকট, পরিবেশ দূষণ হ্রাস ও অবকাঠামোর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এরদোগান।

১৯৯৭ সালে জনসম্মুখে তিনি বলেন- “মসজিদ আমাদের সেনানিবাস, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক।" এই উক্তির পর সেকুলার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তিনি মেয়র পদ থেকে অপসারিত হন এবং ১৯৯৯ সালে ৪ মাস কারাগারে ছিলেন। মুক্তির পর ২০০১ সালে তিনি জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলাপম্যান্ট পার্টি (একেপি) প্রতিষ্ঠা করেন।

২০০২ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দল ‘একেপি’ জয় লাভ করে এবং এরদোগান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। পরবর্তী আরও দুই মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ফলে ২০০৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৮ সাল থেকে চলমান কুর্দি বিদ্রোহ বন্ধের লক্ষ্যে ২০১২ সালে তিনি কুর্দিস্তান পিপলস পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে এ আলোচনা ব্যর্থ হয়।

প্রধানমন্ত্রী অবস্থায় তিনি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ তুরস্কের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হন। কিন্তু ক্রমেই তিনি কিছুটা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একেপি সরকারকে উৎখাতের অভিযোগে তিনি ২০১৩ সালে বেশ কিছু সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠান। পরের বছরই তিনি টুইটার ও ইউটিউব নিষিদ্ধ করে সোস্যাল মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সর্বোচ্চ মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। পরে ২০১৫ সালে প্রথম দফা নির্বাচনে তার দল একেপি জয়লাভ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে তার দল কোয়ালিশন সরকার গঠন করে এবং ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন এরদোগান।

২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তার বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান করা হয়। তিনি এ অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত তুরস্কের বিদ্রোহী নেতা ফেতহুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেন। এ অভিযোগে হাজার হাজার সামরিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও কারাগারে পাঠানো হয় এবং অনেককে নজরদারীতে রাখা হয়।

২০১৮ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচন দেন এবং প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তুরস্কের সামরিক প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একক ক্ষমতা চলে যায় প্রেসিডেন্টের হাতে। ফলে এক নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে তুরস্কের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তবে সিরিয়ায় চলমান সংকটে তুরস্কের ভূমিকার জন্য অনেকেই এরদোগানের সমালোচনা করে থাকেন।

কূটনৈতিক দক্ষতা ও কৌশল দিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমান তালে সম্পর্ক উন্নত করে চলেছেন তিনি। আর ক্রমেই মুসলিম বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে তুরস্ক।

২০০৬ সালে তিনি রাশিয়া সরকারের থেকে স্টেট মেডেল পুরস্কার পান। এছাড়া জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এরদোগান।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধের ঘটনায় তীব্র নিন্দা বিএনপির Dec 12, 2025
img
জামায়াতের তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদির উপর হামলার ঘটনায় তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ তারেক রহমানের Dec 12, 2025
img
সিটি স্ক্যান সম্পন্ন, ওসমান হাদীর মাথায় অস্ত্রোপচার চলছে: চিকিৎসক Dec 12, 2025
img
সব মানুষ বিএনপির পতাকাতলে আশ্রয় নিতে পারবে : সালাহউদ্দিন Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদীকে গুলি করা সন্ত্রাসীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু: ডিএমপি কমিশনার Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদিকে আমাদের খুবই প্রয়োজন: এসএম ফরহাদ Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদিকে গুলি করা দুর্বৃত্তদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ Dec 12, 2025
img
গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদি, শাহবাগে বিক্ষোভ Dec 12, 2025
img
ভোট কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি পক্ষ : শিবির সেক্রেটারি Dec 12, 2025
img
হাদিকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদিকে দেখতে ঢামেক যাচ্ছেন মির্জা আব্বাস ও রিজভী Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ, তীব্র নিন্দা জানাল বিএনপি Dec 12, 2025
img
সালাহর লিভারপুল ছাড়ার গুঞ্জনে স্লটের মন্তব্য Dec 12, 2025
খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির দোয়া মাহফিলে এসে যা বললেন আলাল Dec 12, 2025
নির্বাচনে লড়তে ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরতে হবে তারেক রহমানকে Dec 12, 2025
img
অভ্যুত্থান শুরু হবে, রাজধানীর ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান সাদিক কায়েমের Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদিকে দেখতে হাসপাতালে হাসনাত ও জারা Dec 12, 2025
img
ওসমান হাদির বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানালেন চিকিৎসক Dec 12, 2025
img
হাদিকে গুলি, চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন জুলকারনাইন সায়ের Dec 12, 2025