ব্যর্থতা থেকে সফলতা : বিখ্যাত ১০ ব্যক্তির অনুপ্রেরণার গল্প

আমরা সবাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার পেছনে ছুটে চলেছি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে মানুষ হিসেবে আমাদের চেষ্টার কোন অন্ত নেই।

স্কুল, কলেজ, কোচিং, সংস্থা, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ যেকোনো কর্মক্ষেত্রে মানুষ একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে চলেছে।  তবে মজার ব্যাপার হলো সাফল্য পাওয়ার জন্য আমরা আমাদের প্রচেষ্টার তুলনায় প্রায়শই বেশি কিছু আশা করি এবং খুব দ্রুত সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে চাই।

মানুষের এই সাফল্য ক্ষুধা তাকে সভ্যতা বিকাশে সহায়তা করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এবং অধ্যবসায়।

জীবনে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও আসতে পারে, সেক্ষেত্রে দমে গেলে হবে না। বরং নতুন উদ্যমে আবারো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ ব্যর্থতাই সফলতার চাবিকাঠি।

আসুন পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত ১০ ব্যক্তির জীবনের এমন কিছু গল্প জেনে নিই, যা আমাদের সফলতার পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

স্টিভ জবস

বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল’ প্রতিষ্ঠার জন্য স্টিভ জবস আইকনিক ফিগার হিসাবে খ্যাত। বর্তমানে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ ও ৪ হাজারের বেশি কর্মচারী থাকলেও মাত্র দুজন মিলে একটি ভাঙ্গা গ্যারেজ থেকে প্রতিষ্ঠানটির শুরু করেছিলেন। 

স্টিভ জবস তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে, ছিলেন দুই প্রতিষ্ঠাতার একজন। অবাক করা বিষয় হলো জবসকে বরখাস্ত করা হয়েছিল অ্যাপল থেকে।

তবে স্টিভ জবস থেমে থাকেননি, এবার তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘নেক্সট’। অন্যদিকে বাজার হারাতে শুরু করেছিল অ্যাপল।

ফলে বাধ্য হয়েই স্টিভ জবসকে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। সেই সাথে কিনে নেয় জবসের ‘নেক্সট’ কোম্পানিটি। এবার স্টিভ জবস ফিরলেন সিইও হয়ে।

বিল গেটস

প্রথম জীবনে মারাত্মক ব্যর্থতার মুখোমুখি হলেও, ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম সফটওয়্যার কোম্পানির মালিক হয়েছেন বিল গেটস। মাইক্রোসফটের মতো এমন একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস হার্ভাডের একজন ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী।

তার প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘ট্র্যাফ-ও-ডেটা’ ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। এটি তার জীবনের সব থেকে বড় ব্যর্থতা। প্রতিষ্ঠানটিতে বিল গেটসের বিনিয়োগকৃত সম্পূর্ণ পুঁজি  নষ্ট হয়ে যায় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তার উচ্চ শিক্ষাও শেষ করতে পারেননি।

তবে, এত বড় ব্যর্থতার পরেও থমকে যাননি বিল গেটস। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যারের প্রতি তীব্র ভালবাসা এবং আবেগ তাকে ‘মাইক্রোসফট’ নামের বিশাল সফটওয়্যার সংস্থা প্রতিষ্ঠার পথে পরিচালিত করেছিল।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

তার বিখ্যাত উদ্ভাবন এবং বিজ্ঞানের প্রতি অবদানের কারণে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিশ্বজুড়ে প্রায় সবার পরিচিত এক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এবং অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে- ‘সাফল্য ব্যর্থতারই একটি অগ্রগতি এবং যে কখনোই ব্যর্থ হয়নি সে সত্যিকার অর্থেই সফল ব্যক্তি হতে পারে না।’

শৈশবকালে তিনি লাগাতার ব্যর্থতায় ভোগেন। নয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সাবলীল ভাবে অনর্গল কথা বলতে পারতেন না। এমনকি স্কুল থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

জুরিখ পলিটেকনিক স্কুলে তার ভর্তি নেয়া হয়নি। কিন্তু তিনি নিজেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহাসাগরের এক খ্যাতিমান রত্ন হিসাবে প্রমাণ করছিলেন এবং শেষ অবধি ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন।

আব্রাহাম লিংকন

এই মহান ব্যক্তিত্ব আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার গেটিসবার্গ এড্রেসের জন্য বিখ্যাত। গণতন্ত্রের পথিকৃৎ হিসেবে বিশ্বজুড়ে তার নাম পরিচিতি।

কিন্তু তিনিও বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত প্রবল ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে লিংকন তার ব্যবসায় ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং পরে ১৮৩৬ সালে তিনি বড় ধরনে নার্ভাস ব্রেকডাউনের সম্মুখীন হন।

বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পরেও তিনি ১৮৫৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় লাভ করেন। তবে লিংকনের জীবন থেমে থাকেনি, ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ১৮৬১ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন।

জে.কে.রোলিং

সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই ‘হ্যারি পটার’ এর লেখক হিসাবে বিখ্যাত জে.কে.রোলিং। তিনি হার্ভার্ডের এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তার ব্যর্থতা সম্পর্কে সরাসরি কথা বলেছিলেন।

বৈবাহিক জীবনে ব্যর্থ হয়ে একাকী জীবনযাপন করছিলেন, তখন তার কোনো চাকরীও ছিল না। জীবনসঙ্গীহীন অবস্থা এবং বেকারত্বের মতো কঠিন পরিস্থিতি তাকে গতিশীল লেখক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করতে বাধ্য করেছিল।

তার লেখা ‘হ্যারি পটার’ বইটি অনেকেই ছাপাতে রাজি হয়নি। মেনুস্ক্রিপ্ট ফটোকপি করার মতো টাকাও তখন তার কাছে ছিল না। তাই বারবার সেটি তাকে টাইপ করতে হতো।

তবে তার উদ্যম ও অধ্যবসায়ের জোরে আজকে তিনি বিশ্বের অন্যতম আলোচিত একজন লেখক।

 

মাইকেল জর্ডান

ক্রীড়া বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম নামী একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল জর্ডান। শৈশবে প্রথমদিকে তার উচ্চতা কম থাকার কারণে প্রায়শই তাকে দল বাছাই প্রক্রিয়ায় বাদ দিয়ে দেয়া হতো।

বড় হওয়ার পরে তিনি বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে শুরু করেন। তবে প্রথমদিকে তিনি নয় হাজারেরও বেশি শটে ব্যর্থ হন এবং তিন শতাধিক গেম হেরে যান।

এর ফলে তিনি প্রচুর হতাশ হয়েছিলেন। তবে তার নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় এবং ধারাবাহিকতা তাকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নেয়।

ওয়াল্ট ডিজনি

ওয়াল্ট ডিজনির নাম শোনেননি বর্তমান প্রজন্মে এমন লোক খুব কম আছেন। তিনি একজন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট। তিনি মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক প্রভৃতি বিখ্যাত কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত।

এমনকি তিনিও তার জীবনে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হন। তিনি  সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানের প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এটি তাকে স্কুল থেকে সরে যেতে এবং তার পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে।

তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘লাফ-ও-গ্রাম স্টুডিওস’ সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যায়। এরপর তিনি মিসৌরি নিউজপেপার নামে একটি সংবাদপত্র সংস্থায় যোগদান করেন।

তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সৃজনশীল না হওয়ার কারণে সেখান থেকেও তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ

এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বিশ্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী এবং শিল্পী হিসেবে পরিচিত। তিনি তরুণ চিত্রশিল্পীদের আইকন।

ক্রমাগত ব্যর্থতা, মানসিক অসুস্থতা ও সম্পর্কের ব্যর্থতার ফলে তিনি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। সমগ্র জীবনে এই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাত্র একটি পেইন্টিং বিক্রি করেছিলেন, যা তাকে চারুকলা ও চিত্র জগতে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে এবং তার অবস্থান ধরে রেখেছে।

স্টিফেন কিং

বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক খ্যাতিমান লেখক হিসাবে বিখ্যাত মি. স্টিফেন কিং। তিনিও তার জীবনে বেশ কয়েকবার দুর্ভাগ্য এবং ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

তিনি শৈশবে মাদক-অ্যালকোহল আর দারিদ্রের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তিনি সেই ব্যর্থতার জীবন থেকে উঠে আসতে পেরেছেন।

তিনি তার ‘শখ’ লেখালেখির প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং একে নিজের পেশায় পরিণত করতে সক্ষম হন। তিনি নতুন কপিরাইটিং পদ্ধতির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি নতুন লিখন শৈলীর বিকাশ করেছেন।

স্টিভেন স্পিলবার্গ

স্টিভেন স্পিলবার্গ তার চলচ্চিত্রের জন্য বিখ্যাত, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি অসংখ্য রেকর্ডের অধিকারী এবং অনেকগুলো জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরষ্কার অর্জন করেছেন।

এই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতাও তার জীবনে বেশ কয়েবার ব্যর্থতার শিকার হয়েছেন। পরীক্ষায় ভাল গ্রেড পেতে সক্ষম না হওয়ার ফলে তাকে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনবার বরখাস্ত করা হয়েছিল।

তার আবেগ এবং উৎসর্গের ফলস্বরূপ তিনি সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন। তিনি সর্বমোট ৫১টি দুর্দান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তিনটি অস্কার পুরষ্কার জিতেছেন।

সুতরাং ব্যর্থতা আমাদের জীবনেরই একটি অংশ তা মেনে নিতে হবে এবং সাময়িক ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সফলতা কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফসল। কোন ব্যর্থতা এই পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

তথ্যসূত্র:ইউরস্টোরি.কম

 

টাইমস/এনজে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজসিক সংবর্ধনায় দায়িত্ব নিলেন বিএসএমএমইউ'র নতুন উপাচার্য Mar 28, 2024
img
রোদে পোড়া ত্বকের যত্নে হলুদের ঘরোয়া প্যাক Mar 28, 2024
img
শহরের চেয়ে গ্রামে বিয়ে-তালাক বেশি Mar 28, 2024
img
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৫ Mar 28, 2024
img
বাংলাদেশে মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে সমর্থন অব্যাহত থাকবে: ম্যাথিউ মিলার Mar 28, 2024
img
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত Mar 28, 2024
img
নিষেধাজ্ঞার ৩ দিনের মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত Mar 27, 2024
img
জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত বিএনপির : কাদের Mar 27, 2024
img
‘তুফান’এর পোস্টার প্রকাশ, গ্যাংস্টার রূপে আসছেন শাকিব খান Mar 27, 2024
img
বিএনপির মন্ত্রীদের বউরা ভারত থেকে শাড়ি এনে বিক্রি করত : প্রধানমন্ত্রী Mar 27, 2024