সিমন বলিভার: ফেডারেল লাতিন আমেরিকার স্বপ্নদ্রষ্টা

সিমন বলিভার। একজন ভেনিজুয়েলান যোদ্ধা ও রাষ্ট্রনেতা। স্প্যানিশ সাম্রাজ্য থেকে লাতিন আমেরিকার দেশ সমূহকে স্বাধীন করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ফেডারেল লাতিন আমেরিকার স্বপ্নদ্রষ্টা।

বিশেষ করে ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডোর, পেরু ও বলিভিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। লাতিন আমেরিকায় গণতন্ত্রের যে বীজ বপন করা হয়েছিল তা বলিভারের হাত ধরেই।

১৭৮৩ সালের জুলাই মাসে ভেনিজুয়েলার কারাকাশে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বলিভার। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। বড় হয়েছেন পারিবারিক বন্ধু, চিকিৎসক, শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে। তবে তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে শিক্ষক সিমন রদ্রিগেজ এর।

এছাড়া তার জীবদ্দশায় সংগঠিত ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকান বিপ্লবের লক্ষ্য ও আদর্শ তার জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তিনি যখন গ্র্যান কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন সেইসব গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে নিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

১৮০৪ সালে প্যারিসে থাকাকালে তিনি নেপোলিয়ানের নেতৃত্ব খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং অনুভব করেছেন যে, লাতিন আমেরিকার জন্য এরকম একজন শক্তিশালী নেতার প্রয়োজন।

একসময় স্প্যানিশ শাসকদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে তার গুরু রদ্রিগেজ ভেনিজুয়েলা থেকে পালিয়ে যান। তখন বলিভারের বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। পরে তিনি সামরিক অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন এবং সামরিক কৌশল ও দক্ষতা অর্জন করেন।

১৮০২ সালে মাদ্রিদে পড়াশোনা করার সময় তিনি মারিয়া রদ্রিগেজকে বিয়ে করেন। ভেনিজুয়েলায় ফিরে আসার কিছুদিন পরই তার স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর আর বিয়ে করেননি তিনি।

১৮১৩ সালে কলম্বিয়ার তুঞ্জায় বলিভারকে সর্বপ্রথম সামরিক কমান্ড দেয়া হয়। স্পেনের কবল থেকে ভেনিজুয়েলাকে মুক্ত করতে এখান থেকেই তিনি সামরিক কর্মসূচি শুরু করেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু এটা ছিল সাময়িক।

চাপের মুখে ১৮১৫ সালে তিনি ভেনিজুয়েলা ছাড়তে বাধ্য হন এবং জ্যামাইকা পালিয়ে যান। তবে হাইতির সহযোগিতায় ১৮১৬ সালে পুনরায় ভেনিজুয়েলায় প্রবেশ করেন এবং স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

প্রথমে তিনি নিউ গ্রানাডা স্বাধীন করেন। পরে তার নেতৃত্বেই স্পেন থেকে পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করে ভেনিজুয়েলা ও ইকুয়েডর। এসময় থেকেই তিনি ‘এল লিবারেদর’ বা ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৮১৯ সালে ‘অ্যানগস্তুরা অ্যাড্রেস’ শীর্ষক এক বিপ্লবী ভাষণ দেন। যেখানে তিনি দাসত্বকে অন্ধকারের কন্যা এবং মূর্খ লোকদেরকে স্বজাতি ধ্বংসের অন্ধ উপাদান বলে মন্তব্য করেন।

১৮২১ সালে তিনি লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত গ্র্যান কলম্বিয়া এর প্রেসিডেন্ট হন। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।

একপর্যায়ে স্পেনের কাছ থেকে পেরুকে স্বাধীন করতে তিনি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। অবশেষে ১৮২৪ সালে তিনি সফল হন। ফলস্বরূপ ১৮২৫ সালে তার নামানুসারেই পেরুর নামকরণ করা হয় “দ্য রিপাবলিক অব বলিভিয়া”।

তার একটি বড় স্বপ্ন ছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদলে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করা। কিন্তু মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। ফলে পুরো দেশকে একহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি একনায়কতান্ত্রিক ভূমিকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৮২৮ সালে এক হত্যাচেষ্টা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। দাসপ্রথা বলিভিয়ার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রচণ্ড দাসপ্রথা বিরোধী।

বলিভিয়ার সংবিধান রচনাকালে তিনি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আদলে আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার বিধান করেছিলেন। তবে গ্র্যান কলম্বিয়ায় এই ধারণাটি খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ফলে আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে থাকাটাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাই ১৮৩০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

সে বছরের শেষ দিকেই তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে দেয়া এক বিদায়ী ভাষণে তিনি অত্যন্ত আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন-

“কলম্বিয়াবাসী! আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে এই অঞ্চলের সুখ। আমার মৃত্যুতেও যদি এই অঞ্চলের বিভেদ দূর হয় এবং একটি ইউনিয়ন গঠিত হয়, তবে আমি কবরে গিয়েও শান্তিতে থাকব”

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেশে কত দামে স্বর্ণ ও রুপা বিক্রি হচ্ছে আজ? Sep 18, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

হ‍্যারি কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন মিউনিখ Sep 18, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

দাপুটে পারফরম্যান্সে শিরোপা ধরে রাখার মিশন শুরু পিএসজির Sep 18, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদকে ৩-২ গোলে হারাল লিভারপুল Sep 18, 2025
অভিযোগে ফুঁসে উঠল জনতা, ভাঙচুর হলো বিএনপি অফিস Sep 18, 2025
১৭ বিয়ে ও প্রতারণার দায়ে বরিশালের বন কর্মকর্তা বরখাস্ত Sep 18, 2025
ভোট দিতে পারবেন না হাসিনাসহ শেখ পরিবারের সদস্যরা Sep 18, 2025
হ্যান্ডশেক বিতর্কে জয় পাকিস্তানের, দায়িত্ব হারালেন পাইক্রফট! Sep 18, 2025
img
মাদারীপুরে পানিতে ডুবে প্রাণ গেল ২ ভাইয়ের Sep 18, 2025
রেফারির দুটি পেনাল্টি সিদ্ধান্তেই বদলে গেল ম্যাচের রঙ Sep 18, 2025
সালমানের ‘পজেসিভনেস’ এই নাকি শেষ হয়েছিল ঐশ্বরিয়ার প্রেম! Sep 18, 2025
জেমস বন্ড লুকে ‘ডন ৩’ বাজিমাত করবেন রণবীর সিং! Sep 18, 2025
img
ফেনীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেল যুবকের Sep 18, 2025
img
জামালপুরে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রিক্তা গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
রাশেদ খানের জন্য সুখবর, হতে পারেন ডাকসুর জিএস Sep 18, 2025
img
পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর Sep 18, 2025
img
বরিশালে সারজিস ও হাসনাতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা Sep 18, 2025
img
শাহরুখ খানের মতো আর দ্বিতীয় কাউকে পাবে না দর্শক : অনুরাগ কাশ্যপ Sep 18, 2025
img
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসা ভাড়া না দিতে মাইকিং Sep 18, 2025
img
৫ দফা দাবিতে দেশবাসীকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জামায়াতের Sep 18, 2025