বিগ বি: বলিউডের শাহেনশাহ

পৃথিবীতে যারা সফলতার চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করেছেন তাদের কেউই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন নি। তাদের কারোরই সফলতার পথ মসৃণ ছিল না। ক্যারিয়ারের পদে পদে তারা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কখনো কখনো চরম দুর্দিনে কেটেছে তাদের জীবন। কিন্তু কখনো তারা হাল ছেড়ে দেন নি। বরং একবার যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন ছুঁতে তারা ডিঙ্গিয়ে গেছেন অনেক বাঁধার পাহাড়। অবশেষে হয়েছেন সফল।

আজ আমরা এমনই একজন সফল মানুষের গল্প শোনাব। যার ক্যারিয়ার জীবনে ছিল নানা ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। নানা চড়াই-উৎরাই শেষে আজ তিনি শতাব্দীর সেরা অভিনেতাদের একজন। তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন ভারতের সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের একজন, বলিউডের শাহেনশাহ এবং শতাব্দীর সেরা অভিনেতা- অমিতাভ বচ্চন। বলিউডে যিনি বিগ বি নামে পরিচিত।

অমিতাভ বচ্চন ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন কায়স্থ হিন্দু কবি। জন্মের সময় তার নাম ছিল ‘ইনকিলাব’। পরে একজন কবির পরামর্শে তার নাম রাখা হয় ‘অমিতাভ’, যার অর্থ ‘এমন প্রদীপ যা কখনো নিভে না’।

তিনি শেরউড কলেজ, কিরোরি মল কলেজ এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে ফিল্ম স্টার হবার স্বপ্ন নিয়ে বোম্বে চলে আসেন।

কিন্তু একজন অভিনেতা হবার জন্য তার চেহারাটা যথেষ্ট সুন্দর ছিল না। তাই প্রথম দিকে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান নি। তবে তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন। তার কথা বলার ভঙ্গী ও উচ্চারণ ছিল চমৎকার। এই সম্পদটাকেই তিনি কাজে লাগালেন এবং একজন ব্যাকগ্রাউন্ড ভাষ্যকার হিসেবে ফিল্মে কাজ শুরু করেন।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। এই সুযোগে ইন্দিরা গান্ধীর সুপারিশে একসময় তিনি ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান। খাজা আহমেদ আব্বাস পরিচালিত ‘সাত হিন্দুস্থানি’ মুভি দিয়ে তিনি অভিনয় জগতে পা রাখেন।

তবে একজন নবাগত হিসেবে তিনি খুব একটা সফল ছিলেন না। প্রথম দিকে তার অভিনীত ১৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১২টি ছবিই ব্যর্থ হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রকাশ মেহরা পরিচালিত ‘জাঞ্জীর’ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছবিতে তার সহঅভিনেত্রী ছিলেন জয়া বচ্চন। যাকে তিনি পরবর্তীতে বিয়ে করেছিলেন।

তার এই ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল হয়, যা অমিতাভকে বলিউডে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। কারণ এই ফিল্মের মাধ্যমেই সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে প্রথমবারের মত ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের জন্য তিনি মনোনয়ন পান।

এরপর তিনি একে একে শক্তি, কালাপাথর, মঞ্জিল, রাম বলরাম, নসিব, অভিমান, নামক হারাম, কুলি, অগ্নিপথ, শাহেনশাহসহ অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অভিনেত্রী জয়া ও রাখীর সঙ্গে তার অভিনয়জুটি বেশ জনপ্রিয় হয়। সত্তর ও আশির দশকে বলিউডের এক তরুণ জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন অমিতাভ। সেই সময় তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, ফরাসি পরিচালক ফ্রান্সিস তাকে “ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি” হিসেবে ডাকতেন।

১৯৮৪ সালে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ১৯৮৭ সালে আবার বলিউডে ফিরে আসেন। কিন্তু এই সময় জাদুঘর, তুফান, ম্যায় আজাদ হোসহ একে একে তার অনেকগুলো ছবি বলিউডে চরম ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি ‘অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিমিটেড’ নামে প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই সময়টাতে তার ক্যারিয়ারে দুর্দিন নেমে আসে। এমন কি তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক সংকটে পড়ে যায়।

১৯৯৯ সাল নাগাদ তার দেনা ৯০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই সময় কংগ্রেস পার্টি নির্বাচনে হেরে যায়। ফলে তিনি রাজনৈতিক সমর্থনও হারিয়ে ফেলেন। অনেকে মনে করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ার হয়তো এখানেই শেষ।

কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি। আবার নতুন করে শুরু করেন। ২০০০ সাল থেকে তিনি জনপ্রিয় টিভি শো ‘কোন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তার অভিনীত কাবি খুশি কাবি গাম, পিকু, ভগবান, কাকীসহ বেশ কিছু ছবি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। এরপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি। বর্তমানে তিনি বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব।

এ পর্যন্ত ১৯০টি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। তিনি ৪১ বার মনোনয়নসহ ১৫টি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। বলিউড ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও তিনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।

ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৮৪ সালে পদ্ম শ্রী, ২০০১ সালে পদ্ম ভূষণ, ২০১৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘লিজিওন অব অনার’ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

ফিল্ম, টিভি শো, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে বর্তমানে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এক সময়ের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: