অকুতোভয় বীর সৈনিক শহীদ সার্জেন্ট জ‎হুরুল হক  

রাজা-মহারাজাদের শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য বীর সেনানি শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ সফল হয়েছেন, কেউবা বিসর্জন দিয়েছেন নিজের প্রাণটাই। তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব শহীদ সার্জেন্ট জ‎হুরুল হক।

বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সাহসী সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হক। যেসব বীর বাঙ্গালির মহান আত্মত্যাগের ফলে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং যা শেষ পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয় তাদের অন্যতম একজন সার্জেন্ট জ‎হু‎রুল হক। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ও শহীদ ব্যক্তিত্ব।

এই মহান ব্যক্তি ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে ইন্টারমেডিয়েড পাশ করেন এবং ওই বছরই পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। কর্মক্ষেত্রে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি খুব দ্রুত 'সার্জেন্ট' পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন ১৭তম। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে আরও কয়েকজন আসামিসহ তাকে ঢাকা (কুর্মিটোলা) ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। এই একই অভিযোগে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ৩৫ জনকে আসামী করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে।

পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা এ মামলাকে জনসাধারণ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলারূপে বিবেচনা করে। তারা আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ করেন এবং অবিলম্বে এ মামলা রদ করে কয়েদীদের মুক্তি দাবি করেন। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এ মামলার বিচারের শেষ তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে সরকার এ তারিখ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্যান্টমেন্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে।এতে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন অভুক্ত শিশুকে ধরে এনে বন্দীশিবিরের সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে। কয়েকজনবন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে হাবিলদার 'মনজুরশাহ' বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ করেন। জহুরুল হক সে আদেশ উপেক্ষা করে মনজুর শাহের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এতে মনজুরশাহ প্রচণ্ডভাবে রাগান্বিত হয়ে রাইফেলের বেয়োনেট লাগিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসেন। কিন্তু জহুরুল হক পাশ কাটিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং বিজয়ী বীরের মতো কামরার দরজায় গিয়ে তাকে রাইফেল ফেরত দেন।

পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা জহুরুল হক ঘর থেকে বের হলে মনজুর শাহ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।ও ই গুলিটি তার পেটে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ১০ টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি অতিথি ভবন ও অন্যান্য সরকারি অট্টালিকায় অগ্নি সংযোগ করে। গণ-আন্দোলনের চাপে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রদ করতে বাধ্য হয়। ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ তারিখে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হল ‘ইকবাল হল’ এর নাম পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলটির নামকরণ করেন 'শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল'।

এছাড়া তার স্মৃতি রক্ষার্থে চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক।

সার্জেন্ট জহুরুল হকের সহকর্মীরা তাকে একজন অনমনীয় ও সৎ সৈনিক হিসেবে জানতেন। তারা অনেক সময় তাঁকে ‘মার্শাল’ বলে সম্বোধন করতেন। জহুরুল হক একজন ভালো চিত্রশিল্পী ও খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি কাঠের শিল্পকর্মেও পারদর্শী ছিলেন। তার কিছু চিত্রকর্ম বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

সার্জেন্ট জহুরুল হক স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন। তার শহীদ স্মৃতি পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীকালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জহুরুল হক 'বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান' হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবেন চিরকাল।

 

টাইমস/এসআর/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেশের বাজারে বাড়ল স্বর্ণের দাম Jul 04, 2025
img
পাবনায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩ Jul 04, 2025
img
কেন পরিচালকের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন পরেশ রাওয়াল? Jul 04, 2025
img
হজ শেষে দেশে ফিরেছেন ৬৪ হাজার ৮৬৪ হাজি Jul 04, 2025
img
ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি কমলেও বেড়েছে রপ্তানি ও রাজস্ব আয় Jul 04, 2025
img
বার্সা-রিয়ালের দুই মহারণ চূড়ান্ত, আবারও প্রাণ ফিরছে ক্যাম্প ন্যুতে Jul 04, 2025
img
ঢাকায় এক দিনে ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি, আজও হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা Jul 04, 2025
img
মুগদায় জনতার পিটুনিতে তরুণের মৃত্যু Jul 04, 2025
img
অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছে নৌবাহিনী Jul 04, 2025
img
তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলো রাশিয়া Jul 04, 2025
img
না ফেরার দেশে জোটা, স্তব্ধ লিভারপুল Jul 04, 2025
img
দেশজুড়ে টানা ৩ দিনের ছুটি ঘোষণা Jul 04, 2025
img
এ ধরনের নিয়োগ ফ্যাসিস্ট সরকারও করেনি : ডা. খালিদুজ্জামান Jul 04, 2025
img
আগামী কয়েকদিনে বাড়তে পারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ Jul 04, 2025
img
তারেক রহমানের ভুয়া 'চাচাতো ভাই' সেজে প্রতারণা, গ্রেফতার ১ Jul 04, 2025
img
নওগাঁয় শ্বশুরবাড়িতে অবৈধভাবে চাল মজুত, ধরা খেলেন জামাই Jul 04, 2025
img
সূচকের উত্থানে দেশের পুঁজিবাজারে সপ্তাহজুড়ে চাঙ্গাভাব Jul 04, 2025
কিম জং উনের সাথে রাশিয়ার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করলো ইউক্রেন! Jul 04, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের আলোচিত সব খবর Jul 04, 2025
‘বিপ্লব ভণ্ডুল করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ’ Jul 04, 2025