সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের এক বয়স্ক ফকিরকে ধরে তার চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সবখানেই এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা। অনেকেই এটিকে ব্যক্তির ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখছেন।’
ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের চেহারা আসলে কোন পথে যাচ্ছে? ধর্মীয় আচার-অনুশীলন ও ভিন্ন জীবনধারার মানুষদের প্রতি সহনশীলতার ঐতিহ্য যেখানে ছিল, সেখানে এখন কেন উগ্রতা, ভয় এবং নিপীড়নের ছবি উঠে আসছে? এক বৃদ্ধ ফকিরের চুল কেটে দেওয়া যেন সেই বৃহত্তর সংকটের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে শুধু দেশের ভেতর নয়, বাইরেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে গোলাম মাওলা রনি এসব কথা বলেন।
গোলাম মাওলা রনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন অনেক বয়স্ক সৃষ্টিয়াপন্থী ফকির আছেন, যাদেরকে কেউ দরবারি পাগলও বলে থাকে। তারা নিজেদেরই এভাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এ রকম হাজার হাজার মানুষ রয়েছে, কেউ হয়তো মাজারভক্ত, আবার কেউ তরিকাপন্থী।
যারা মাজারভক্ত তারা সাধারণত লম্বা দাড়ি রাখেন, চুল কাটেন না, হাতে অনেকগুলো বালা পরেন, গলায় মালা থাকে। অনেকে গান করেন, কেউ কেউ কিঞ্চিৎ গাঁজাও খান এবং বিভিন্ন মাজারে ঘুরে বেড়ান। এই মানুষগুলো অনেকাংশেই সংসারের প্রতি বিরাগী তাদের সংসারের প্রতি লোভ-লালসা থাকে না। তাদের এই জীবনধারার জন্য পরিবার-পরিজনও অনেকাংশে তাদের সন্ন্যাসী হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
তিনি জানান, সন্ন্যাস বা সংসারবিরাগী হয়ে স্রষ্টাকে খোঁজার ভাবনা অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব প্রধান ধর্মেই এর একটি উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি বৈদিক ধর্মের নৃগোষ্ঠীগুলোর ছোট ছোট আঞ্চলিক ধর্মেও বহু সন্ন্যাসী দেখতে পাবেন। যারা বন, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত ও মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়ে থাকে হাজার বছর ধরে। এই সমাজও তাদের এভাবেই গ্রহণ করেছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, পৃথিবীর অনেক মহান কাজ এবং আবিষ্কার এ ধরনের মানুষদের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। আমরা আজ ইবনে সিনাকে নিয়ে গর্ব করি, জাবির আল হায়ানকে নিয়ে গর্ব করি। আমরা আর্কিমিডিস, ইউক্লিডিস, পিথাগোরাস, সক্রেটিস এবং ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস, পেরিক্লিস এই সব গ্রিক দার্শনিকদের কৃতিত্বও মানি। তারা সবাই এক রকম ভাবের পাগল ছিলেন।
তিনি আরো জানান, বিজ্ঞানীদের মধ্যে আইনস্টাইন, নিউটনের মতো মানুষরা ভিন্নভাবে চিন্তা করতেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন এক অর্থে ‘ভাবের পাগল’। পোশাক-আশাক, চালচলন সব কিছুতেই ছিল এক ধরনের অদ্ভুততা। তারা সমাজের প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা হয়ে নিজেরা এক ভিন্ন জগৎ গড়ে তুলেছিলেন। হয়তো দেখা যায়, লাখো ভাবের পাগলের মধ্যে থেকে একজন বিশেষ গুণ বা যোগ্যতা অর্জন করেন। আপনি লালন শাহকে ভাবুন বা শাহ আব্দুল করিমকে। বাংলার আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এসব কবিয়ালরা এমন সব সৃষ্টিকর্ম করে গেছেন, যা আমরা সাধারণ মানুষ হাজার বছর চেষ্টা করেও একটি অক্ষর সেইভাবে সৃষ্টি করতে পারব না। এই ভাবের পাগলদের ভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে অসাধারণ অনেক কিছু।
গোলাম মাওলা রনি বলেন, এ রকমই একজন ভাবের পাগল এক বৃদ্ধকে ধরে তার মাথা কামিয়ে দিয়েছে। যারা মাথা কামিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ বলছেন তারা ইসলামপন্থী কেউ বলছেন তৌহীদ জনতার লোক, আবার কেউ বলছেন জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের মাথায় পাগড়ি, গায়ে লম্বা জুব্বা, মুখে সাদা বা কালো দাড়ি দেখে অনেকে তাদের আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে মিল খুঁজে নিচ্ছেন, মনে করছেন তারা হয়তো ভবিষ্যতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন বৃদ্ধকে ধরে মাথা কামিয়ে দেওয়া। কেন এটা করা হলো, তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। কিন্তু মূল ব্যাপার হলো এটা এখন সারা পৃথিবীতে এক ধরনের কেলেঙ্কারিতে রূপ নিয়েছে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য বিরাট এক দায় তৈরি করেছে। যারা আমাদের দেশকে চেনেন বা আমাদের নিয়ে যাদের মাথাব্যথা আছে এখন তারা সবাই এ বিষয়টি লক্ষ্য করছেন। তারা বলছেন এ কি শুরু করলেন ড. ইউনূস। তার সময়ে উগ্রপন্থীরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শুধু ধর্মকে ব্যবহার করে উগ্রতা নয় রাজনীতিতে, পেশায়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তারা উগ্রতা দেখিয়েছে। যে যেখানে পেরেছে, ড. ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে কিংবা জুলাই আগস্ট বিপ্লবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করেছে। যা খুশি তাই করতে পারে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারি সবই তারা করতে পারে, অথচ কোনো বিচার হয় না। তারা যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই গিয়ে পাইকারি হারে কোর্ট–কাচারি, থানা পুলিশ পর্যন্ত দখলে নিয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা জাল করে যেকোনো মানুষকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারে। এভাবে ভয়–ভীতি দেশের ভেতরে যেমন ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি দেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ছে।
এবি/টিকে