মূল্যস্ফীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ

এবার দক্ষিণ এশিয়ায়ও মূল্যস্ফীতিতে রেকর্ড করল বাংলাদেশ। বিদায়ি সেপ্টেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত আগস্টে ছিল ৮.২৯ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত মাসিক ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন তা কিনতে লাগছে ১০৮ টাকা ৩৬ পয়সা।

ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে এবং ক্রয়ক্ষমতা কমছে।

মূল্যস্ফীতি বাড়ায় জনগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, যখন পণ্যের দাম বাড়ে কিন্তু মানুষের আয় একই থাকে, তখন এটি কার্যত এক ধরনের ‘অদৃশ্য কর’-এর মতো প্রভাব ফেলে। সংসারের ব্যয় মেটাতে সাধারণ মানুষকে তখন ঋণ নিতে হয় বা খাবার, পোশাক, চিকিৎসা ও যাতায়াতের খরচে কাটছাঁট করতে হয়।

সরকার মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সেই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, যেখানে ঋণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, সুদহার বৃদ্ধি এবং অর্থ সরবরাহ সীমিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজারে সেই প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি টানা ৮ শতাংশের ওপরে থাকায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ে চাপ বাড়ছে।

বিবিএসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৬৪ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৭.৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এ হার বেড়ে ৮.৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে ব্যয়ের চাপ বেশি। সেখানে গড় মূল্যস্ফীতি ৮.৪৭ শতাংশ। শহরে ৮.২৮ শতাংশ।

গ্রামীণ পরিবারগুলো বিশেষ করে পোশাক, জ্বালানি ও পরিবহন খরচে বেশি সমস্যায় পড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দেশ বাংলাদেশ। ভারতে মূল্যস্ফীতি ২.৭ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫.৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১.৫ শতাংশ, নেপালে ১.৬৮ শতাংশ, আর মালদ্বীপে ৪.৬ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে এই হার দ্বিগুণেরও বেশি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশ, ২০১৩ সালের পর এটি সর্বোচ্চ। এডিবি পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ শতাংশে নামলেও তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ থাকবে।

বিবিএসের সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য বলছে, সামান্য বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। অথচ চালের বাজারে গেলেই ক্রেতাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হচ্ছে। কারণ সরকারের হিসাবেই যে আয় হচ্ছে, তারচেয়ে ব্যয় বেশি। সহজভাবে বলতে গেলে ভাত, ডাল, ডিম, মুরগি, পেঁয়াজের মতো প্রতিদিনের খাবারের দাম ক্রেতাদের পকেট থেকে আগের চেয়ে বেশি টাকা বের করে নিচ্ছে। যে খাতে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় সেই খাবার-দাবারের দাম এখনো উঁচুতেই রয়ে গেছে। ফলে সরকারি পরিসংখ্যান ইতিবাচক হলেও ভোক্তার জীবনে সেই স্বস্তি আসছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি তেলের দাম, আমদানি নির্ভরতা, দুর্বল বাজার তদারকি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা এই চাপের মূল কারণ। তাঁরা বলছেন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো কার্যকর বাজার তদারকি, কঠোর মুদ্রানীতি ও কৃষিশিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিমুখী নীতি না নিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, খাদ্য খাতের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে না। পরিসংখ্যানে ইনফ্লেশন কমলেও বাস্তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে।

তিনি মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা জরুরি। পাইকারি পর্যায়ে মনোপলি ভাঙা, খাদ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো এবং কৃষিপণ্যের সরাসরি বিপণন চ্যানেল শক্তিশালী করতে হবে। না হলে খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকবেই।

ইএ/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
৯ ঘণ্টা না খেয়ে পাহাড়ে আটকা ছিলেন মানসী সেনগুপ্ত Oct 07, 2025
img
ছক্কা হাঁকানোয় শীর্ষে পাকিস্তান, ২ এ বাংলাদেশ Oct 07, 2025
img
যেখানে হাত দেই সেখানেই দুর্নীতি : শারমীন এস মুরশিদ Oct 07, 2025
img
আওয়ামী লীগের ভার্সন তৈরির চেষ্টা প্রতিহত করা হবে : সারজিস Oct 07, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী Oct 07, 2025
img
দলীয় আচরণ করলেই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন : সিইসি Oct 07, 2025
img
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ-তুরস্কের পর্যালোচনা Oct 07, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও ভারত থেকে চাল কিনবে সরকার : অর্থ উপদেষ্টা Oct 07, 2025
img
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন ৩ জন Oct 07, 2025
img
নতুন ছবি করতে যাচ্ছি : মিষ্টি জান্নাত Oct 07, 2025
img
স্ত্রী-সন্তানসহ সাবেক এমপি সামছুল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা Oct 07, 2025
img
রাষ্ট্রকে সঠিক ট্র্যাকে তুলতে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন : চিফ প্রসিকিউটর Oct 07, 2025
img
জাহ্নবীর প্রেমের কাহিনী : গুঞ্জন নাকি সত্য? Oct 07, 2025
img
ফের ইসির কাছে শাপলা প্রতীক চেয়েছে এনসিপি Oct 07, 2025
img
ক্রীড়া উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিসিবি নির্বাচন: আমিনুল Oct 07, 2025
img
দীপিকার হিজাব ও রণবীরের দাড়ি, নতুন রূপে তারকা দম্পতি Oct 07, 2025
img
ঘর পরিচালনা করা সহজ নয়: অমিতাভ বচ্চন Oct 07, 2025
img
শহীদ আবরার ফাহাদ আমাদের প্রেরণার বাতিঘর : সাদিক কায়েম Oct 07, 2025
img
অবসর ঘোষণার পরই আবার কনসার্টে তাহসান Oct 07, 2025
img
টস জিতে ফিল্ডিংয়ে ইংল্যান্ড Oct 07, 2025