মাত্র ৪০ বছরের জীবনে গল্পের শেষ নেই শতাব্দীর সেরা কণ্ঠস্বর জন লেননের। তিনি বিদ্রোহ, শান্তি আর ভালোবাসার অমর বার্তা ছড়িয়েছিলেন বিশ্বজুড়ে।
রক সংগীতের কিংবদন্তি জন লেননের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালের ৯ অক্টোবর। যুক্তরাজ্যের বন্দর শহর লিভারপুলের নিউক্যাসল রোডের একটি ছোট ফ্ল্যাটে জন্ম নেয়া এ সংগীতশিল্পী শুধু গাইতেন না, বলতেন মানুষের মনের কথাও। গান দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন বিশ্বের কোটি ভক্তের হৃদয়।
লেননের জীবন শুরু পারিবারিক বিচ্ছেদের ছায়ায়। বাবা আলফ্রেড লেনন নাবিক ছিলেন। জাহাজ নিয়ে শত্রুদেশে পাড়ি দেয়ায় তাকে কারাগারে যেতে হয়। যে কারণে জন্মের পর বাবাকে তেমন দেখতে পাননি লেনন। মা জুলিয়া আমোদপ্রিয় হওয়ায় একাকী সন্তানকে বড় করতে চাননি। যে কারণে বিচ্ছেদ হয় আলফ্রেড-জুলিয়ার।
লেননের বয়স যখন ৪, তখন জুলিয়া আরেকটি বিয়ে করেন। তখন জুলিয়া তার নিঃসন্তান বোন মিমির কাছে তুলে দেন লেননকে। মিমি-জর্জ দম্পতির কাছে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর ভালোবাসার ছায়ায় বড় হতে থাকে লেনন।
শৈশব থেকেই মাউথ অর্গান বাজাতে পারতেন লেনন। নতুন বিয়ের পর একবার তার মা দেখতে এসে তাকে একটি গিটার কিনে দেন। তবে গান নয়, লেননের ঝোঁক ছিল ছবি আঁকাতে।
১৭ বছর বয়সে ছবি আঁকার নেশা তাকে নিয়ে যায় লিভারপুল আর্ট কলেজে। দুনিয়া তখন এলভিস প্রিসলির গানের জাদুতে বিভোর। গানকে ভালোবাসায় তখন ক্লাবেব গান গাওয়া শুরু করলেন।
লেনন কখনো গানের স্কুলে পড়েননি। গিটার দিয়ে গান গাওয়ার অভ্যাস থেকেই লিভারপুলের ম্যাথিউ স্ট্রিটের দ্য কাভার্ন ক্লাবে নিয়মিত গান গাওয়া শুরু করেন। তার সঙ্গে তখন গান গাইতেন দুই বন্ধু পল ম্যাকার্টনি ও জর্জ হ্যারিসন।
এভাবে যখন ভালোই চলছিল জীবন তখন লেনন তার মা জুলিয়ার মৃত্যুর খবর পান। শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী এক কনস্টেবলের গাড়িতে চাপা পড়ে মারা যান জুলিয়া। হঠাৎ মায়ের মৃত্যু বদলে দেয় লেননের জীবনপথ।
দুঃখ ভুলতে তিনি ডুবে যান গানের জগতে। বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘কোয়ারিম্যান’,যা পরে পরিণত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’এ।
১৯৬৩ সালে ‘প্লিজ প্লিজ মি’দিয়ে ব্রিটেনে ঝড় তোলে দ্য বিটলস। পরের বছর ‘আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড’ তাদের নাম ছড়িয়ে দেয় পুরো বিশ্বে। কিন্তু জনপ্রিয়তার উচ্ছ্বাসের মধ্যেই শুরু হয় ভেতরের টানাপোড়েন। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় দ্য বিটলস।
এরপর যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে ঝুঁকে পড়েন এ গায়ক। লেখেন যুদ্ধবিরোধী গান ‘গিভ পিস আ চান্স’; গানটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বিশ্ব শান্তির প্রতীক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ এতই শক্তিশালী ছিল যে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন লেননকে নিজ দেশ যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিলেন।
লেনন চেয়েছিলেন এমন একটা পৃথিবী, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই। নেই ক্ষুধা-দারিদ্র্য, নেই মানুষে মানুষে বিভেদ। এমনকি নেই কোনো ধর্ম, স্বর্গ বা নরক। তার এ দৃষ্টিভঙ্গিই ২০০২ সালে বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ ১শ ব্রিটনস এর তালিকায় অষ্টম অবস্থানে নিয়ে যায় তাকে।
বিশ্বনন্দিত এ তারকার জীবন থেমে যায় ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর। নিউইয়র্কের রাস্তায় এক পাগল ভক্তের গুলিতে থেমে যায় তার হৃদস্পন্দন। তবে কালের খেয়ায় আজও থেমে যায়নি তার সুর। মৃত্যুর ৪৫ বছর পেরোলেও পৃথিবীর মানুষ লেননের গানে আজও খুঁজে পায় অমর ভালোবাসা, শান্তি আর মানুষের প্রতি বিশ্বাসের হাতছানি।
কেএন/টিকে