এবার জামায়াতের বিরুদ্ধে নাহিদের তোপ : মাসুদ কামাল

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেছেন, আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটি মেরুকরণ এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এতদিন মনে করা হচ্ছিল, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মধ্যে একধরনের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। অনেকে ভাবতেন -জামায়াত যা বলে, এনসিপি তাই করে অথবা এনসিপির বিভিন্ন কর্মসূচি সফল করতে জামায়াত বা ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা সেখানে উপস্থিত থাকেন। এমন অনেক ঘটনাই আমরা দেখেছি।

তিনি বলেছেন, এনসিপির যতগুলো সফল কর্মসূচি ছিল -আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে শাহবাগ ও যমুনার সামনে যে কর্মসূচিগুলো হয়েছিল, সেগুলো সফল হয়েছিল মূলত ছাত্রশিবিরের উপস্থিতির কারণে। জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও শিবিরের বিপুল উপস্থিতি ছিল। তাই অনেকেই ভেবেছিলেন, আগামী নির্বাচনে হয়তো জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে একটি জোট গঠিত হতে পারে। কিন্তু আমরা বিরোধ দেখলাম গত সেপ্টেম্বর মাসে।

জামায়াত যখন পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করল, যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির উপস্থিতি দেখা যায়নি। সেখানে তাদের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মূলত ‘পিআর’ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

রবিবার (১৯ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে মাসুদ কামাল এসব কথা বলেন।

মাসুদ কামাল বলেন, এনসিপি বলছিল, তারা পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চায় উচ্চকক্ষে; কিন্তু জামায়াতসহ অন্যদলগুলো বলছিল, তারা নিম্নকক্ষেও পিআর পদ্ধতি চায় -অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এখান থেকেই বিরোধের সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এই মাসের ১৬ তারিখে ‘ঐক্যমত কমিশন’-এর ব্যানারে একটি জরুরি সভা ডাকা হয়। সেখানে জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি -সব দলই উপস্থিত ছিল। বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা জানান, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং শুক্রবার সেই বিষয়ে স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে।

এনসিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। জামায়াত এতে আপত্তি জানালেও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি-তারা শুধু জানায়, অনুষ্ঠানে যাবে, তবে স্বাক্ষর করবে কি না, পরে সিদ্ধান্ত নেবে।

তিনি বলেন, শুক্রবারের অনুষ্ঠানে এনসিপি শেষ পর্যন্ত যায়নি। অনেক নাটকীয়তা হয়েছে, দাবিদাওয়া উঠেছে, কিন্তু তারা অনড় থেকেছে। জামায়াত অংশ নিয়েছে এবং জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হলো -এনসিপি এখন জামায়াত থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা পথে হাঁটছে। সেই দিনই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল ঐক্যমতের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে কাগজে স্বাক্ষর করেছে। পরদিন শনিবার এনসিপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শুক্রবার যে দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, তারা গণঅভ্যুত্থান ও জনগণ থেকে ছিটকে গেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, নাহিদ ইসলাম কাদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেছেন? যারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে -সবাইকে, না শুধু বিএনপিকে, না কি জামায়াতকে? অনেকে মনে করেন, এই মন্তব্য মূলত জামায়াতকে উদ্দেশ্য করেই করা, কারণ জামায়াতের সঙ্গে এনসিপি একসময় ময়দানে একসঙ্গে ছিল। ফলে স্বাক্ষর করে জামায়াত যেন গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে -এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন নাহিদ ইসলাম।

তবে এখানেই শেষ নয়। আজ রবিবার নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক পেজে আরো কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, জামায়াতের নেতৃত্বে যে পিআর আন্দোলন চলছে, তা আসলে একটি ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’। তার ভাষায়, ঐক্যমত কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই জামায়াত ইচ্ছাকৃতভাবে পিআর ইস্যু সামনে এনেছে। এটি এক ভয়ঙ্কর অভিযোগ।

তিনি লিখেছেন -আমরা ভিত্তিগত সংস্কারের চারপাশে একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম এবং জুলাই সনদের আইনি কাঠামোকে বিস্তৃত জাতীয় ঐক্যমতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত ও তার মিত্ররা এই এজেন্ডা ছিনতাই করে একে সুকৌশলে পিআর ইস্যুতে নামিয়ে আনে এবং বিষয়টি নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল না সংস্কার বরং ছিল কৌশলী প্রতারণা।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, জামায়াত কখনোই সংস্কারমূলক আলোচনায় অংশ নেয়নি -না জুলাই অভ্যুত্থানের আগে, না পরে। তারা কখনো কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি, এমনকি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।

মাসুদ কামাল বলেন, এই বক্তব্যে নাহিদ ইসলাম মূলত জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান ও রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। হয়তো এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে হিসাব-নিকাশে গড়মিল হয়েছে—সেটা আলাদা কথা। কিন্তু যে যুক্তি ও ভাষায় নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্য উপস্থাপন করছেন, সেটিকে উপেক্ষা করা যায় না। এবং এই সমালোচনা এসেছে কার কাছ থেকে? একসময় জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এনসিপির কাছ থেকেই। অনেকে বলেন, জামায়াতের মিত্র হিসেবে অতীতে বিএনপিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতি করার পর জামায়াত এখন বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এখন আবার এনসিপির সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তাদের ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলার অভিযোগ উঠছে। বাস্তবে কী ঘটছে, তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কারণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা, প্রতিক্রিয়া, এবং পারস্পরিক দূরত্বই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত চিত্রটি পরিষ্কার করবে।

 পিএ/টিকে 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আজ ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত দিবস Dec 18, 2025
img
সম্পর্ক ভাঙা মানেই ব্যর্থতা নয়, সমাজকে নতুন করে ভাবতে বললেন মিমি Dec 18, 2025
img
যুক্তরাজ্য সফরে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান Dec 18, 2025
img
এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী Dec 18, 2025
img

ড. রেদোয়ান

১০০ বছরেও ক্ষমতার ধারে-কাছে যেতে পারবে না জামায়াত Dec 18, 2025
img
বেনাপোল বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ ৪৩ টাকা  Dec 18, 2025
img
২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলো ভারতের ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান Dec 18, 2025
img

আইপিএল ২০২৬

কলকাতায় মুস্তাফিজের সতীর্থদের কার কত পারিশ্রমিক? Dec 18, 2025
img
ভারতে পালানোর সময় কেরানীগঞ্জ মডেল থানা মৎস্যজীবী লীগের সাধারন সম্পাদক গ্রেপ্তার Dec 18, 2025
img
পাঞ্জাবে ম্যাচ চলাকালে খেলোয়াড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা Dec 18, 2025
img
আবারও চোট শুভমানের, বিশ্বকাপের আগে নতুন উদ্বেগ ভারতের Dec 18, 2025
img
চট্টগ্রামের আলোচিত 'সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ ও তার স্ত্রীর জামিন স্থগিত Dec 18, 2025
img
বিশ্ববাজারে আবারও বাড়ল স্বর্ণের দাম Dec 18, 2025
img
এমবাপের জোড়া গোলে তালাভেরাকে হারিয়ে শেষ ষোলোয় রিয়াল মাদ্রিদ Dec 18, 2025
img
মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং, রোমাঞ্চকর ম্যাচে তবুও হার দুবাই ক্যাপিটালসের Dec 18, 2025
img
টাইব্রেকারে ফ্লামেঙ্গোকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন পিএসজি Dec 18, 2025
img
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করলে দেশের জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না : ইশরাক Dec 18, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাহিদ গ্রেপ্তার Dec 18, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই হলো সবচেয়ে বড় ঢাল: রাণী মুখার্জি Dec 18, 2025
img
তারেক রহমানের ফ্লাইটে দেশে ফিরতে নেতাকর্মীদের হিড়িক, শেষ সব টিকিট Dec 18, 2025