নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের গল্প শোনালেন বাঁধন

লাক্স সুন্দরী থেকে নায়িকা, এরপর নিজেকে পুরোদস্তুর অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের গল্প শোনালেন আজমেরী হক বাঁধন। জানালেন তথাকথিত ‘আদর্শ নারী’র খোলস ছেড়ে একজন পরিপূর্ণ ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার সংগ্রামের কথা; যে যাত্রাপথে তাকে ডিভোর্স, রিহ্যাব সেন্টার, তীব্র বিষণ্ণতা ও আইনি লড়াইয়ের মতো কঠিন বাস্তবতা পাড়ি দিতে হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের না বলা অধ্যায়গুলো দর্শক-শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন এই জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী।



বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’–এর ‘কথামালা-১৩’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। ‘অভিনয়, অভিনয়শিল্পী এবং আমার জীবন’ শিরোনামে বক্তব্য উপস্থাপনের পর বাঁধন দর্শকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের অন্ধকার অধ্যায় তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি বাঁধন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে এবং ডিভোর্সের পর চরম সংকটে পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম বিয়ে হয় ১৯ বছর বয়সে। ডিভোর্সের পর আমার শেষ পরিণতি হয় একটা রিহ্যাব সেন্টারে। আমি সিভিয়ার ডিপ্রেশনের পেশেন্ট ছিলাম, সঙ্গে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি ছিল। আমি কিন্তু সেখান থেকে সারভাইভ করেছি।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘জীবনে বহুবার এমন হয়েছে যখন আমি শুধু ভেঙে পড়িনি, একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিলাম। তখন বিষণ্ণতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’

বাঁধন বলেন, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ২০১৮ সালের একটি ঘটনা। সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানের বাবা আমার কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ওই ঘটনা আমাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। যেই সমাজে আমি বেড়ে উঠেছি, সেই সমাজ, দেশের আইন, এমনকি আমার পরিবার—সবাই আমাকে বলেছিল, “না, এভাবে হবে না। আমরা যেভাবে সেট করে দিয়েছি, তোমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে”।’

তবে সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের কাছে হার না মেনে তিনি আইনি লড়াইয়ে নামেন এবং মেয়ের সম্পূর্ণ অভিভাবকত্ব লাভ করেন, যা ছিল উপমহাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী রায়। বাঁধন বলেন, ‘ওই সময়টায় আমি সবচেয়ে অসহায় বোধ করেছি। নিজেকে একদম ভেঙেচুড়ে ফেলার পর আমি ওখান থেকে উঠে এসেছি। আমার মনে হয়েছিল, এই সমাজে আমি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকব। আমার অধিকার আমাকেই বুঝে নিতে হবে।’

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ভাঙতেও সোচ্চার তিনি। অকপটে বলেন, ‘আমি ক্রনিক ডিপ্রেশনের পেশেন্ট, আমার বর্ডারলাইন পার্সোনা‌লিটি ডিসঅর্ডার আছে এবং আমি নিয়মিত অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট খাই। এগুলো নিয়ে কথা বললে সবাই আমাকে পাগল ভাববে। আমাকে কিন্তু পাগল বলেছেও। যখন কেউ কথায় পারে না, তখন বলে—তোমার তো মাথা খারাপ। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কারণ আমি ভালো আছি।’

ব্যক্তিগত জীবনের এই উত্থান-পতনই তাকে অভিনয়ে নতুন করে প্রাণ দিয়েছে বলে জানান বাঁধন। একসময় শুধু টাকার জন্য অভিনয় করলেও পরে থেরাপিস্টের এক প্রশ্নে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।

এরপরই তার জীবনে আসে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর মতো চলচ্চিত্র। পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে একজন অভিনেত্রী হিসেবে নতুন করে জন্ম দিয়েছেন।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে ২০০৬ সালের ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতার স্মৃতিচারণা করে বাঁধন বলেন, ‘প্রথমে যখন আমি লাক্স থেকে বের হই, তখন সবাই আমাকে “লাক্স বা সাবান সুন্দরী” বলত এবং আমি ওটা মোটামুটি উপভোগ করতাম। কিন্তু অল্প বয়সেই মনে হয়েছিল, পড়ালেখা শেষ করাটা জরুরি।’

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ম্যাজিক লণ্ঠন সদস্য জেরিন আল জান্নাত। এতে আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রবিষয়ক তাত্ত্বিক ও গবেষক আ-আল মামুন। আয়োজনে সমাপনী বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ম্যাজিক লণ্ঠন সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার।

আরপি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গরু চুরির মামলায় কারাগারে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিষ্কার Oct 24, 2025
img
যুক্তরাজ্যে আলোচিত মামলায় হারলো অ্যাপল Oct 24, 2025
img
দয়া করে পাগলামী যুদ্ধ নয়: নিকোলাস মাদুরো Oct 24, 2025
img
মিসরের মধ্যস্থতায় প্রতিপক্ষ ফাতাহ’র সঙ্গে বৈঠক করল গাজা নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী Oct 24, 2025
img
ওয়ান্দা নারার নতুন ত্রিভুজ প্রেমে নাম জড়াল বিশ্বকাপজয়ী এনজোর Oct 24, 2025
img
নির্বাচনের প্রাক্কালে আস্থার সংকট দেখা যাচ্ছে : জিল্লুর রহমান Oct 24, 2025
img
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ Oct 24, 2025
img
ভারত সিরিজের মাঝেই স্কোয়াডে ব্যাপক রদবদল অস্ট্রেলিয়ার Oct 24, 2025
img
কোনো রাজনৈতিক দল নয় আমার সমস্যা ভারতীয় আগ্রাসন : ইলিয়াস হোসাইন Oct 24, 2025
img
ভোটকেন্দ্রে আনসার সদস্যরা প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে: ডিজি আনসার Oct 24, 2025
img
শীতের আগমনে রাজধানীতে সবজির দামে স্বস্তি Oct 24, 2025
img
শুধু বেঁচে থাকার চেয়ে জীবন উদযাপন করাই শ্রেয়: পরীমণি Oct 24, 2025
img
দেব ভুল বলেছে: শুভশ্রী Oct 24, 2025
img
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টকে কটূক্তি করলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও Oct 24, 2025
img
জামায়াত শুরু থেকেই জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে : রুমিন ফারহানা Oct 24, 2025
img
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কৃষকদের ভোগান্তি আর থাকবে না: রুহুল আমিন Oct 24, 2025
img
এনসিপিকে বিতর্কিত করতে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে : হান্নান মাসউদ Oct 24, 2025
img
উপদেষ্টাদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে: মাসুদ কামাল Oct 24, 2025
img
নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের গল্প শোনালেন বাঁধন Oct 24, 2025
img
রোগীদের সুস্থতায় চিকিৎসকদের পরম আনন্দ : চসিক মেয়র Oct 24, 2025