বাংলা সঙ্গীতের আধুনিক ধারায় শায়ান চৌধুরী অর্ণবের নাম উচ্চারণ করলেই আলাদা এক আবহ ভেসে ওঠে। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসেন, সমাজমাধ্যমে অনুপস্থিত, তবু সৃষ্টির আলোয় তিনি আচ্ছন্ন। কোক স্টুডিও বাংলার রূপকার, স্বাধীন সঙ্গীতের এক শান্ত অথচ দৃঢ় মুখ, যিনি নিজেকে গায়ক নয়, বরং সুরকার ও সঙ্গীতকার হিসেবে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
সম্প্রতি তাঁর নতুন অ্যালবাম ‘ভাল লাগে না’ মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে অনুষ্ঠান শেষে ফিরেই এখন সেই অ্যালবামের প্রচার ও ভিডিওচিত্র নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্ণব। তবে তাঁর মতে, এটি তাঁর প্রথম সম্পূর্ণ নিজস্ব গান নিয়ে তৈরি অ্যালবাম। আগেও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন, আর সেই কারণেই বহু মানুষ তাঁর গানকে রবীন্দ্রনাথের গান বলে ভেবে বসেন। “অনেকে ভাবেন আমি ‘মাঝে মাঝে তব’ নিজের গান বলেছি। আসলে তা নয়,” জানালেন অর্ণব, “যাঁরা গোঁড়া মনোভাবের, তাঁদের ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমি দায়ী নই।”
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা অর্ণব মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার একটিমাত্র ধরন নয়। তিনি বলেন, “আমি শান্তিদেব ঘোষের ছাত্র বিজয় সরকারের কাছে গান শিখেছি। তিনি স্বরলিপি মেনে যেমন গান শেখাতেন, তেমনই গলা ছেড়ে, লয় বাড়িয়ে গান গাওয়ার স্বাধীনতাও দিতেন। শান্তিনিকেতনে কেউ গোঁড়া ছিলেন না, বরং উৎসাহ দিয়েছেন।”
নিজেকে গায়ক বলতে নারাজ অর্ণব। তাঁর ভাষায়, “আমি গাইতে পারি না, তবে সুর করতে আর গান সাজাতে ভালোবাসি। শ্রোতারা আমার উপস্থাপনাটা পছন্দ করেন।” প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা না পেলেও এসরাজ ও শ্রবণশক্তির ওপর নির্ভর করে নিজস্ব ধারা গড়ে তুলেছেন তিনি।
কোক স্টুডিও বাংলার যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। তখন তাঁর চিন্তা ছিল—শিল্পী নয়, আগে গান বেছে নিতে হবে। “গানই আমাদের আসল নায়ক,” বললেন অর্ণব। “তারপর দেখা হয় কে গাইবে, কোন গান কিসের সঙ্গে মিশবে- সব মিলেই দীর্ঘ প্রক্রিয়া।” প্রথম সিজন তাঁকেই একা সামলাতে হয়েছিল। এখন প্রীতম হাসানসহ অন্য সঙ্গীত প্রযোজকেরা যুক্ত হয়েছেন, ফলে চাপ কিছুটা কমেছে।
দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় অর্ণব নিয়মিত কলকাতায় কাজ করেন না। তিনি বলেন, “ঢাকায় ব্যস্ততা থাকে, আবার কূটনৈতিক জটিলতায় ভিসা পাওয়াও সহজ নয়। তবে আমন্ত্রণ পেলে কাজ করব। আমি দুই দেশেরই সন্তান- সতেরো বছর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। শান্তিনিকেতনের বন্ধুরা, প্রকৃতি- সব কিছুই মিস করি।”
সম্প্রতি তিনি অরিজিৎ সিংহের সঙ্গে দেখা করেছেন জিয়াগঞ্জে। “অরিজিৎ ঠিক আমার মতোই, সাধারণ, লাজুক, নিভৃতচারী। খুব ভালো মানুষ,” বললেন অর্ণব।
তাঁর মতে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন স্বাধীন সঙ্গীতে দারুণ কাজ করছে। “অঙ্কনের ‘যদি বিরহ থাকে’ গানটা শুনে অবাক হয়েছি,” বললেন তিনি। “ভারতে এখন বলিউডের প্রভাব এত বেশি যে ইন্ডিপেনডেন্ট গান জায়গা পাচ্ছে না।”
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা প্রকাশ্য নন অর্ণব। স্ত্রী সুনিধি ও তিনি শিল্পজীবন আর সংসার- দুই-ই সামলান নিজের মতো করে। “সব দায়িত্বই সুনিধির কাঁধে,” অকপট স্বীকার তাঁর। তবে তিনি বলেন, “সুনিধি আমার চেয়ে ভালো গায়িকা, দর্শক ওকে সহজেই গ্রহণ করেছে।”
সমাজমাধ্যমে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়েও তিনি পরিষ্কার, “আমি ব্যক্তিগত জীবন প্রকাশ্যে আনতে চাই না। ফোনে চার্জ না থাকলে দু-তিন মাস ফোন ছাড়াই থাকতে পারি। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
শান্তিনিকেতনের মুক্ত আকাশ, গাছপালা, সাইকেল চালানো, গান শোনা- এসবের মধ্যেই অর্ণব আজও বাঁচেন। শিল্প, সুর আর নীরবতাই তাঁর আশ্রয়। তাঁর কথায়, “যা পুরনো, তাই মিস করি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আশা করি এই পরিবর্তন আমাদের ভালো কিছুই এনে দেবে।”
টিএম/এসএন