শাহজালাল বিমানবন্দরে চরম অব্যবস্থাপনা, বিপর্যস্ত আমদানি সেবা

ধোঁয়া সরে গেছে, জ্বলন্ত আগুনও নিভেছে—কিন্তু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিস্থিতি যেন আরও জটিল, আরও বিশৃঙ্খল। আগুনের পর যে বিশাল অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন পরিণত হয়েছে দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা ও হাহাকারের বড় উদাহরণে। দুই ঘণ্টার কাজ আটকে আছে দিনের পর দিন, আর চার সপ্তাহ পার হলেও এখনও তৈরি হয়নি কোটির ক্ষতির সঠিক হিসাব।

অবিশ্বাস্য ও ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ডে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরস্থ ইমপোর্ট কার্গো ওয়্যারহাউস পুরোপুরি পুড়ে যাওয়া এবং অপূরণীয় ক্ষতির প্রায় চার সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। ঘটনার বিহ্বলতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। কয়েক ঘণ্টা ধরে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম নিউজ, পোস্ট, ছবি, ভিডিও জুড়ে সবাই দেখেছে ধাপে ধাপে কীভাবে গোটা ইমপোর্ট কার্গো ওয়্যারহাউস পুরোপুরি জ্বলে গেছে আগুনে। দেশের আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল এবং বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগ বা বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় এই বিমানবন্দর দিয়ে। রাষ্ট্রের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) এভাবে জ্বলে যাবে আর এর পরদিন থেকেই কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে—তা কারও ধারণাতেও ছিল না।

প্রত্যক্ষ বিবেচনায় ২৭ ঘণ্টা চেষ্টার পর নির্বাপিত এই আগুনে পুড়ে গেছে আনুমানিক ১২ হাজার কোটি টাকার পণ্য। তবে এই সোজা হিসাবটিই এর সবটুকু নয়। এই পণ্য পুড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদনকারী ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ এখন অবধি অননুমেয়। শুধু বলতে পারা যায় যে, প্রত্যক্ষ ক্ষতির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির কারণ এই অগ্নিকাণ্ড, এতে কোনো ভুল নেই। অগ্নিকাণ্ড ঘটার দিনই দুটি কর্তৃপক্ষের অধীনে তদন্ত করার কথা ঘোষণা করেছিল সরকার। তদন্ত, প্রতিবেদন এবং করণীয় নির্ধারণ ব্যবস্থা—সবই প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সময়ের এই হিসাব কত দীর্ঘ হবে?

দুর্ঘটনার দিন স্থগিত হয়ে যাওয়া বিমান চলাচল সন্ধ্যায় শুরু হলেও আমদানিকৃত মালামাল কোথায় কীভাবে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত থাকবে তার যথাযথ ব্যবস্থা এখন অবধি হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরের ৯ নম্বর গেট দিয়ে আমদানিকৃত মালামাল খালাস নেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে তা একেবারেই দায়সারা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতার বাইরে প্রকৃত সমাধানের কিছুমাত্র সমাধান দিতে পারেনি। আমদানিকারকদের সুবিধা নিশ্চিত করার প্রসঙ্গ বিবেচনায় দিন-রাত নিরবচ্ছিন্নভাবে মালামাল খালাস নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে বাস্তব চিত্র বিপরীত কথাই বলছে। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকছে মূল্যবান মালামাল। অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সব মালামাল উন্মুক্ত টারমাকে পড়ে ভিজেছে, রোদে শুকিয়েছে। তাতে আমদানিকৃত মালামাল অকেজো বা বাতিল হয়ে গেলেও কারো কিছু যায়-আসে না।

এমন চিত্র অবশ্য এই বিমানবন্দরে নতুন কোনো দৃশ্য বা বিষয় নয়। তবু আগে বিশাল এলাকা জুড়ে ওয়্যারহাউসে প্রচুর মালামাল সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা ছিল। এখন তা লাগামহীন অরক্ষিত পর্যায়ে আছে। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর মালামাল খালাসের ঘোষণা দিয়ে এবং রাউন্ড দ্য ক্লক অর্থাৎ সার্বক্ষণিক মালামাল খালাস নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও কার্যক্ষেত্রে বিষয়টা বাস্তবতা বর্জিত পুরোপুরি অচল এবং অহেতুক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। একটা আমদানি চালানের প্রয়োজনীয় সব কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে ডেলিভারির জন্য কাগজ জমা দিয়ে সিরিয়াল নেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ওই মালামাল ডেলিভারি হচ্ছে না। ডেলিভারির যে কাজটা সম্পন্ন হওয়ার কথা এক/দুই ঘণ্টার মধ্যে তার জন্য ২০-৩০ ঘণ্টা পার করছেন আমদানিকারকদের নিয়োজিত সিএন্ডএফ এজেন্টরা। 

হিতে বিপরীত ভোগান্তিতে নাকাল হচ্ছেন তারা। যে মালামাল দুপুরের মধ্যে ডেলিভারি হওয়ার কথা তার জন্য অপেক্ষা করে মধ্যরাত পাড়ি দিয়েও মালামাল নিতে পারছেন না। রাউন্ড দ্য ক্লক কিছুই আসলে হচ্ছে না, উলটো ১২-১৪ ঘণ্টা অকারণ দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে, পরদিন আবার আসতে হচ্ছে। এভাবে দুদিনও পার হয়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। এরকম চরম ভোগান্তি নিয়ে নানান অভিযোগ অনুরোধের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। অথচ বর্তমান বিশ্বে কোনো কোনো রাষ্ট্র চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই এরকম ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় সেবামূলক স্থাপনার বিকল্প ব্যবস্থা নির্মাণ করে ফেলত। আমাদের তা পারা উচিত ছিল, অন্তত সাত দিনের মধ্যে। নানা রকম সিদ্ধান্ত, নোটিস, সার্কুলার এসব এসেছে একের পর এক কিন্তু প্রকৃত সমাধান কিছুমাত্রও দেখা যায়নি বাস্তবে।

আমদানিকৃত মালামালের জন্য সেবা প্রদানে এমন অব্যবস্থাপনার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন পুড়ে যাওয়া মালামালের আমদানিকারকগণ। চার সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বিমানবন্দরের আমদানি ওয়্যারহাউসে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মালামালের কোনো তালিকা আজ অবধি দিতে পারেনি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট বিমান বাংলাদেশ কিংবা গোটা বিমানবন্দরের মালিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষের অন্য কেউই। অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু মালামালের একটা তালিকা অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ গড়িয়ে প্রকাশ করলেও ওই তালিকায় না থাকা মালামালও আমদানিকারক পরে খুঁজে পেয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। অবিশ্বাস্য রকম এই ব্যবস্থাপনাকে ভুক্তভোগীরা বলছেন চরম অরাজক ব্যবস্থাপনা।

টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বেলা ২টায় খালেদা জিয়ার জানাজা, স্বামীর কবরের পাশে দাফন Dec 31, 2025
img
ঘন কুয়াশায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ Dec 31, 2025
img
শুটিং বাড়ল ভানসালির 'লাভ অ্যান্ড ওয়ার' সিনেমার, মুক্তি পিছিয়ে ২০২৬-এর শেষে Dec 31, 2025
img
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের স্থগিত পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা Dec 31, 2025
img
সন্তান হারানোর পরও থামেনি সোহিনীর লড়াই Dec 31, 2025
img

খালেদা জিয়ার মৃত্যু

মেক্সিকোর ফ্লাইট বাতিল করে ঢাকার পথে রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল Dec 31, 2025
img
খালেদা জিয়া ছিলেন দুঃখের পাষাণে গড়া শুভ্র চন্দনের মতো: আলাল Dec 31, 2025
img

কায়সার কামাল

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নয়, আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন খালেদা জিয়া Dec 31, 2025
img
গোপালগঞ্জ-০৩ আসনে বিএনপি প্রার্থী জিলানী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্ত্রীর মনোনয়নপত্র জমা Dec 31, 2025
এভারেস্টে আরোহীপ্রতি ৪ হাজার ডলার ফি প্রস্তাব নেপালের Dec 31, 2025
img
ঢাকা-১১ আসন ছেড়ে দেওয়া জামায়াত প্রার্থীর বাসায় নাহিদ ইসলাম Dec 31, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Dec 31, 2025
স্বামীর কবরের পাশেই সমাহিত হবেন বেগম জিয়া Dec 31, 2025
img
২০২৬-এর টক্সিক ঘিরে আগ্রহ তুঙ্গে Dec 31, 2025
img
হাকিমির ফেরার ম্যাচে জাম্বিয়াকে ৩-০ গোলে হারাল মরক্কো Dec 31, 2025
img
ডেজাট ভাইপার্সের কাছে ৪৫ রানে হারল সাকিবের দল Dec 31, 2025
img
নতুন বছরে আবার দলকে শীর্ষে তোলার প্রত্যয় ভিনিসিউসের Dec 31, 2025
img
গোবিন্দগঞ্জে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ গেল পথচারী নারীর Dec 31, 2025
img
রোনালদোর দুর্দান্ত গোল, আল ইত্তিফাকের মাঠে ২-২ ড্র করল আল নাসর Dec 31, 2025
img

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ

উলভারহ্যাম্পটনের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও জিততে পারল না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড Dec 31, 2025