রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে শুক্রবার (২১ নভেম্বর)। এদিন সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে রিখটার স্কেল অনুযায়ী ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যা কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
উৎপত্তিস্থল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে হওয়ায় তা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল এটি। এতে অবকাঠামোগত প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শিশুসহ নিহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। আহত আছে কয়েকশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি হওয়া ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তেমন ঝুঁকিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ এ শহরের বেশির ভাগ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। এছাড়া এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে তেমন ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার।
এছাড়া কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার প্লেট ও পশ্চিমে ভারতীয় প্লেট। এর সংযোগস্থলের ওপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর ও মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি লকড হয়ে আছে। দুটি টেকটোনিক প্লেটে গত শত বছরেও বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তাই জমেছে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত শক্তি। যা যেকোনো মুহূর্তে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়ার আশঙ্কা আছে।
ভারত ও মিয়ানমারের প্লেট এবং বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আর এর কেন্দ্র ঢাকার চারপাশের এলাকা হলে রাজধানীর প্রায় দুই লাখ ভবন পুরোপুরি ধসে পড়বে। এমন ঝুঁকি থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় নেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। গ্যাস-বিদ্যুতের অপরিকল্পিত লাইন ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে মৃত্যুকূপে পরিণত হতে পারে পুরো ঢাকা শহর।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির জানান, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে শুক্রবারই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এর আগে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ৪ থেকে ৫ মাত্রার সামান্য বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের বাইরে। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। যেকোনো সময় বাংলাদেশে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে ঠিক কবে হবে সেটি তারা বলতে পারেন না।
ভূমিকম্প নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করেছেন ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, দুটি প্লেট, ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে আজকের ভূমিকম্পটি হয়েছে। কম্পনের তীব্রতা ছিল বেশ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে তা দেশের পটভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। শক্তি আটক অবস্থায় ছিল। এর উন্মোচন শুরু হয়েছে। এখন পরবর্তীকালে ফাঁকা দিয়ে আবার ভূমিকম্প হতে পারে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকায় ঝুঁকির মাত্রা সবসময় বেশি জানিয়ে হুমায়ুন আখতার বলেন, ঢাকার এত কাছে গত কয়েক দশকে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কয়েক প্রজন্ম এরকম ভূমিকম্প দেখেনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ভবনগুলো এখনই পরীক্ষা করা দরকার। বিশেষ করে ঢাকার ভবনগুলোর পরীক্ষা তাৎক্ষণিকভাবে দরকার। এখানে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না, রাজউককে দিয়ে সাধারণ মানুষকে জানান দেবে, সব ভবন পরীক্ষা করে সনদ দিয়ে দেবে যে ভবনগুলো বিল্ডিং কোড অনুযায়ী হয়েছে।
ভূমিকম্পে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবনে ফাটল ধরা প্রসঙ্গে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন ক্ষয়ক্ষতি হবেই। ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ লাখ একতলা-দোতলা। চার থেকে ছয়তলা ভবন প্রায় ছয় লাখের মতো। ১০ তলা, ২০ তলাও রয়েছে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে দু-তিন লাখ মানুষ হতাহত হবে। ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে।
ইউটি/টিএ