ধারাবাহিক ভূমিকম্প কিসের ইঙ্গিত?

রাজধানীতে আবারও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে এ ভূকম্পন্ন অনুভূত হয়। ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি জানায়, ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। এর মাত্রা ছিল ৪.১। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার গভীরে।

এর আগে সোমবার (১ ডিসেম্বর) কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সোমবার দিনগত রাত ১২টা ৫৭ মিনিটে কক্সবাজার শহর, উখিয়া, চকরিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা ভূমিকম্প অনুভব করেন। এরও কয়েকদিন আগে দেশে আরও দুদফা ভূমিকম্প আঘাত হানে

এসব মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন ভূমিকম্প ঢাকার ঝুঁকি কতটা স্পষ্ট করছে, তা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিগত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের নথিভুক্ত ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে ৩৯টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে। এর মধ্যে ১১টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটার এলাকার ভেতরে। অর্থাৎ ২৮ শতাংশের বেশি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে। এসব ভূমিকম্পের মাত্রা ৩ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ৭। এর মধ্যে শুক্রবার নরসিংদীতে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাত্রার (৫ দশমিক ৬) ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ঢাকার ১০০ থেকে ২৬৭ কিলোমিটারের মধ্যে বাকি ২৮টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল।

পাঁচ বছরে ১৮ জেলায় ভূমিকম্প হয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিলেট, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, হবিগঞ্জ, রংপুর, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, পাবনা, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি, চুয়াডাঙ্গা, শরীয়তপুর, যশোর ও কুড়িগ্রাম।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রে একসময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন মো. মমিনুল ইসলাম। এখন তিনি আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নরসিংদীতে এর আগেও ভূমিকম্প হয়েছে। তবে মাত্রা ছিল কম। বাংলাদেশের সীমান্তে তিনটি টেকটনিক প্লেট আছে। এই তিনটি প্লেটই সক্রিয়। প্রতিনিয়ত এখানে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে। প্লেট বাউন্ডারির পাশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে।

মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, নরসিংদীতে একটি সাব-ফল্ট রয়েছে। নরসিংদীতে আগে ছোট ভূমিকম্প হলেও গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এখন বোঝা যাচ্ছে, এই সাব-ফল্ট অনেক বড়। এটা ঢাকার কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে। এই ভূমিকম্প প্রমাণ করল ঢাকা বড় ঝুঁকির মধ্যে।

ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যে পরিমাণ ভূমিকম্পের শক্তি সাবডাকশন জোনে (দুটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল) পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, তার ১ শতাংশের কম নির্গত হয়েছে। ফলে বারবার হওয়া এই ভূকম্পগুলো বড় একটি ভূমিকম্পের পথ খুলে দিয়েছে।

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার আরও বলেন, ভূমিকম্পের পর ‘আফটার শক’ হবে, এমনটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। তবে আফটার শকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভূ-অভ্যন্তরের যে ফাটল বা ফল্ট লাইনটি এত দিন ধরে প্রচণ্ড চাপে একে অপরের সঙ্গে আটকে ছিল, তা নড়তে শুরু করেছে এবং শক্তি নির্গমনের একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে। এমন আফটার শক হতে হতে বড় ভূমিকম্প হবে। সেটা খুবই নিকটে হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব হাসান চারটি কারণে ঢাকার বিপদটা স্পষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকার নৈকট্য একটা কারণ। ঢাকার কাছে এ ফল্টটা সম্পর্কে এত স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সেটা এখন খুলতে শুরু করেছে। যার প্রভাবে সামনে আরও ভূমিকম্প হতে পারে।

মাটির গঠনকে দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করে রাকিব হাসান বলেন, ঢাকার নতুন অংশগুলো খুব নিচু জায়গায় মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে। এমন অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। তৃতীয়ত, ঢাকার ভবনগুলো ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ডিজাইন কোড মেনে হচ্ছে না। চার নম্বর হলো ঢাকা শহরের জনঘনত্ব। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে

২০১৬ সালে ভূমিকম্পের প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলার অংশ হিসেবে ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি হলেও গত এক দশকে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ সেন্টার নির্মাণে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় জায়গাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার যুগ্ম সচিব আবু দাউদ মো. গোলাম মোস্তফা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তেজগাঁওয়ে এক একর জায়গা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভবন নির্মাণ করতে গেলে নির্মাণসামগ্রী রাখার জন্য কমপক্ষে আরও ২৫ বর্গমিটার জায়গা থাকা দরকার। সেটা পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগের জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। বড় দুর্যোগের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন সংস্থার জন্য আরও সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে আমরা সে সংগ্রহ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা উপকূলে আমাদের ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আছেন। নগরে আছে ৪৮ হাজার। তাঁদের যুক্ত করে মানুষকে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতন করার কাজ শুরু করব।’

ইএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ঘরোয়া উপকরণেই তৈরি করুন রেস্টুরেন্টের মতো সস Dec 04, 2025
img
ইনজুরি নিয়ে এবার নেইমারের হ্যাটট্রিক Dec 04, 2025
img
ধারাবাহিক ভূমিকম্প কিসের ইঙ্গিত? Dec 04, 2025
img
ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলাবন্ধনে ফাতিমার অনন্য উপস্থিতি Dec 04, 2025
img
অভিনয়ের গভীরতা বোঝাতে অনন্যাকে নতুন পথ দেখালেন শাহরুখ Dec 04, 2025
img
অভিনয় ছাড়িয়ে প্রযোজনায় নতুন যাত্রা সামান্থার Dec 04, 2025
img
৫ গোলের ম্যাচে এক গোল করেই কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন Dec 04, 2025
img
রাফিনিয়া ব্যালন ডি’অর না জেতায় হতবাক সিমেওনে Dec 04, 2025
img
গাইবান্ধায় ধানের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের দাবিতে বিক্ষোভ Dec 04, 2025
img
নীলফামারীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ২ জনের Dec 04, 2025
img
নবম পে-কমিশন: গেজেটের দাবিতে মহাসমাবেশের ডাক সরকারি কর্মচারীদের Dec 04, 2025
img
লাল কার্ডের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন লুকাস পাকুয়েতা Dec 04, 2025
img
রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচের বিষয়ে নতুন উদ্যোগ Dec 04, 2025
img
রাজধানীতে আবারও ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত Dec 04, 2025
img

লে. কর্নেল রাশেদ কামাল রনি

‘সীমান্তে পুশইন মোকাবিলায় বিজিবি-জনতা একত্রিত হতে হবে’ Dec 04, 2025
img
১১৭২ জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত Dec 04, 2025
img
১৯ দেশের নাগরিকদের অভিবাসন স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র Dec 04, 2025
img

৪ ডিসেম্বর

ইতিহাসের এই দিনে স্মরণীয় যত ঘটনা Dec 04, 2025
জামায়াত মওদুদীবাদে বিশ্বাস করে, ইসলামে বিশ্বাস করে: মির্জা আব্বাস Dec 04, 2025
যুদ্ধের ক্ষত নিয়েও নতুন জীবনের স্বপ্ন, গাজায় ৫৪ দম্পতির গণবিয়ে Dec 04, 2025