ইউক্রেন যুদ্ধের চার বছর পূর্তির প্রাক্কালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে পৌঁছান। এটি ২০২০ সালের পর পুতিনের প্রথম ভারত সফর, যা এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্ক টানাপোড়েনের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই প্রোটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে স্বাগত জানান পুতিনকে। দু’জন পরপর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেন, যা কূটনৈতিক মহলে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই পুতিন সফর
যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করেছে এবং রুশ তেল কেনার কারণে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ভারত রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক হয়ে ওঠে, যা মার্কিন প্রশাসনের অসন্তোষ বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতেই পুতিনের ভারত সফর নয়াদিল্লির জন্য এক কঠিন ভারসাম্য রক্ষার পরীক্ষা।
গার্ড অব অনার, গান্ধী স্মৃতি, মোদি–পুতিন বৈঠক
শুক্রবার সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অব অনার নেওয়ার পর পুতিন সাক্ষাৎ করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে। এরপর মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ রাজঘাটে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয় হায়দরাবাদ হাউসে, যেখানে মোদি ও পুতিন বার্ষিক ভারত–রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন। দুই নেতার সঙ্গে যোগ দেন দুই দেশের শীর্ষ প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রে বেলোউসোভ এবং রাষ্ট্রীয় অস্ত্র রপ্তানিকারক রোসোবোরোনএক্সপোর্টের কর্মকর্তারাও সফরে রয়েছেন।
২৫ বছরের কৌশলগত অংশীদারত্ব—কিন্তু চাপে জ্বালানি বাণিজ্য
ভারত–রাশিয়া কৌশলগত সম্পর্কের ২৫ বছর পূর্তি হলেও জ্বালানি সহযোগিতা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বৃহত্তম তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকওয়েলকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনায় ঝুঁকি বেড়েছে ভারতীয় রিফাইনারদের জন্যও।
ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি রিফাইনার রিলায়েন্স ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, রুশ তেল ব্যবহার করে উৎপাদিত পেট্রোলিয়াম পণ্য আর রপ্তানি করবে না। ফলস্বরূপ, রুশ তেল আমদানি তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামতে পারে।
একই সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় আকারে গ্যাস আমদানি চুক্তি করেছে, যা ভবিষ্যতে জ্বালানি ভারসাম্য আরও বদলে দিতে পারে।
প্রতিরক্ষায় রাশিয়ার প্রভাব বহাল
জ্বালানি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রতিরক্ষায় রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় সহযোগীই রয়ে গেছে। ভারতের মোট অস্ত্র আমদানির ৩৬ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে; ভারতের বিদ্যমান সামরিক সরঞ্জামের ৬০ শতাংশের বেশি রুশ নির্মিত।
সাম্প্রতিক পাকিস্তান–ভারত আকাশ সংঘাতে S-400 সিস্টেমের ভূমিকার পর নয়াদিল্লি আরও কয়েকটি ইউনিট কেনার ব্যাপারে আগ্রহী। পুতিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, রাশিয়ার নতুন সু-৫৭ স্টেলথ ফাইটারও আলোচনায় থাকবে।
‘রাশিয়া একা নয়’—পুতিনের প্রত্যাশিত বার্তা
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রাজন কুমার বলেন, পুতিনের এই সফর মূলত বিশ্বকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা—যে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন নয়।
“একটি গণতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানাচ্ছে—এটি পুতিনের জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ,” মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতের ভারসাম্যের রাজনীতি আরও কঠিন
ওয়াশিংটনের অতিরিক্ত চাপ সত্ত্বেও ভারত জানিয়ে দিয়েছে, তার “কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন” অক্ষুণ্ণ থাকবে। বিশ্লেষকদের মতে, এবারকার মোদি–পুতিন বৈঠক সেই বার্তাই আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরবে—ভারত কোনো পক্ষকেই ক্ষুব্ধ করতে চায় না, আবার কাউকেই ছাড়ও দিতে চায় না।
২৪ ঘণ্টার ঝটিকা সফর শেষে শুক্রবার রাতেই নয়াদিল্লি ত্যাগ করার কথা পুতিনের। তবে তার এই সফর যে ভারত–রাশিয়া সম্পর্কের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে—সেটিই এখন দেখার বিষয়।
ইএ/এসএন