আইন-আদালত আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমাদের সবারই আইনের কিছু সাধারণ বিষয়ে জানা থাকা জরুরী। বাংলাদেশ টাইমস-এর পাঠকদের সুবিধার্থে আমাদের আইন-আদালত বিভাগে এই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখবেন ঢাকা জজ কোর্ট-এর আইনজীবি ইশরাত জাহান মনি। আশা করি আপনাদের সবার কাজে লাগবে।
ধারাবাহিক আয়োজনে আইনজীবি ইশরাত জাহান মনি আজ আপনাদের জানাচ্ছেন জমিজমা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা আমাদের সকলের জানা থাকা জরুরী। যেহেতু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও বড় একটা বিষয়, তাই আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে ভাগ ভাগ করে লিখা হয়েছে।
জমিজমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা:
খতিয়ান: খতিয়ানে (Record of Rights) খতিয়ান নম্বর, জেলা ও মৌজার নাম লিপিবদ্ধ থাকে। এছাড়া একাধিক কলামে জমির মালিকের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, দাগ নং (Plot Number), জমির শ্রেণী, পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। খতিয়ানে কোন এক মৌজায় কোন একজন মালিকের জমির বিবরণ থাকে। আবার একটি খতিয়ানে একাধিক মালিকের জমির বিবরণও থাকতে পারে। এ খতিয়ান গুলো সাধারণত মৌজা ওয়ারী তৈরী করা হয়। অর্থাৎ কোন একটি মৌজার সকল খতিয়ান একসাথে বাধাই করা হয়। এজন্য রেকর্ড বইকে অনেকে সাধারণ বা প্রচলিতভাবে Volume- ও বলে থাকেন।
পড়চা: যখন পৃথক একটি কাগজে এই খতিয়ানের অনুলিপি তৈরী করা হয় তখন তাকে পড়চা বলা হয়। এই অনুলিপি হাতে লিখে বা কম্পোজ করে তৈরী হয়ে থাকে। এই অনুলিপি যখন রেকর্ড রুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় তখন তাকে নকল বা Certified Copy বলে। সহজভাবে পড়চা হলো খতিয়ানের হাতে লেখা বা Compose করা কপি বা খসড়া।
আমরা সিএস, এসএ ও আরএস পড়চার নাম শুনে থাকি। এ গুলো কি? ইতোমধ্যে পড়চা কি সে সম্বন্ধে আমরা একটি ধারণা পেয়েছি। সিএস, এসএ ও আরএস পড়চা হলো আসলে বিভিন্ন রেকর্ডের খসড়া বা অনুলিপি বা কপি। কাজেই পড়চা সিএস, এসএ, আরএস বা মহানগরে জরিপের অর্থাৎ ৪ প্রকার হতে পারে। এছাড়া জরিপ চলাকালে প্রাথমিকভাবে হাতে লেখা একটি খসড়া বিবরণ যাচাইয়ের জন্য জমির মালিককে দেয়া হয়। একে মাঠ পড়চা বা হাত পড়চাও বলে।
পড়চা কোথায় পাবেন?
পড়চা বা রেকর্ডের সহি মুহুরী নকল (Certified Copy) পাওয়া যায় জেলাপ্রশাসকের কার্যালয় (DC office)-এর রেকর্ডরুমে । নির্ধারিত ফী সহ আবেদন করলে রেকর্ড রুম থেকে পড়চা সরবরাহ করা হয়। পড়চা কখনও কোন দালালের কাছ থেকে নিবেন না। এতে ভুল থাকতে পারে। কেবল মাত্র ভার প্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ পড়চাই আসল বা Authentic।
পড়চা কেন প্রয়োজন?
জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবরণ, জমির খতিয়ান-দাগ, অংশ, হিস্যা, শ্রেণী ইত্যাদি জানার জন্য পড়চা প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে জমি কেনা বেচার সময় পড়চা যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়। পড়চা যাচাই এর জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস বা রের্কডরুমে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
মৌজা (Mouza: সার্ভের সময় সাধারণত একই রকম ভূ-প্রকৃতির ভৌগলিক এলাকা স্বতন্ত্রভাবে মাপ-জোক করা হয়। কোন থানা বা উপজেলার এরকম স্বতন্ত্র ভৌগলিক এলাকা বা ভূ-খন্ডই হলো মৌজা। মৌজা জরিপ বা ভূমি ব্যবস্হাপনার একটি একক। কয়েকটি গ্রাম একটি মৌজার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আবার কোন গ্রামেও একাধিক মৌজা থাকতে পারে। মৌজার কোন সুনির্দিষ্ট আয়তন নেই। তবে সাধারণত কোন একটি উপজেলা একাধিক মৌজায় বিভক্ত থাকে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ‘মৌজা’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি term। খতিয়ান বাদ দিলে মৌজার নাম উল্লেখ থাকে। উপজেলাধীন প্রত্যেক মৌজাকে একটি ক্রমিক নম্বর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই নম্বরকে জে.এল নম্বর বলে। এটি স্থায়ী।
তফসিল (Schedule: জমিজমার ক্ষেত্রে তফসিল বলতে আসলে ভূমির পরিচয়কে বুঝায়। অর্থাৎ জমিটি কোথায়, এর মালিক কে ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। তফসিলে জেলার নাম, উপজেলা বা থানার নাম, মৌজার নাম, জমির দাগ-খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করা হয়। এতে অনেক সময় জমির পরিমাণ, শ্রেণী ও মালিকানার বর্ণনাও থাকে।
দাগনম্বর: এটি আসলে কোন সরলরেখা বা বক্ররেখা নয়। দাগ হচ্ছে আসলে জমির Plot Number। আমরা জানি সাধারণত মাপ জোকের মাধ্যমে জমিকে একাধিক অংশে বিভক্ত করা হয়। এর প্রতিটি খন্ডকে দাগ বা Plot বলে। জরিপের সময় এরকম প্রত্যেক খন্ড জমিকে একটি নম্বর দ্বারা সূচিত করা হয়। এই নম্বরকেই দাগ নম্বর বলে।
মৌজা ম্যাপ: আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ দুটো মিলেই পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড। আসলে জরিপের সময় খতিয়ান বা জমির মালিকানার বিবরণ এবং জমির নকশা বা ম্যাপ এক সাথেই তৈরী করা হয়। কেবল মাত্র জমির খতিয়ান দেখে জমি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এজন্য মৌজা ম্যাপ বা জমির নকশার প্রয়োজন হয়। মৌজা ম্যাপ জমি চিহ্নিত করতে বা খুঁজে পেতে খুব সহায়ক। এতে দাগ নম্বর দিয়ে জমি সূচিত করা থাকে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমির পাশাপাশি রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, পুকুর ঈদগাহ ইত্যাদি পাবলিক প্রপার্টিও চিহ্নিত থাকে। মৌজা ম্যাপ পড়চার মতই ডিসি অফিসের রেকর্ডরুম থেকে সংগ্রহ করা যায়।
এওয়াজ বদল (Exchange of Land: অনেক সময় পারস্পরিক ব্যবহারের সুবিধার্থে এবং উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে একজনের সম্পত্তির সাথে আর একজনের জমির দখল বদল বা বিনিময় করা হয়। এটাই এওয়াজ বদল। এরূপ ক্ষেত্রে, জমি বা সম্পত্তি পরস্পর ভোগ দখল করলেও স্বত্ত্ব বা মলিকানার হস্তান্তর হয় না। কেবলমাত্র দখল বদল হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না রেজিস্ট্রেশন করে জমির স্বত্ত্ব বদল করা হয়, ততক্ষণ ঐ জমি পূর্ব মালিকের নামেই থেকে যায়। মনে রাখতে হবে এওয়াজ বদল কেবলমাত্র ব্যবহার বা চাষাবাদের সুবিধার্থে করা হয়ে থাকে।
লেখক:
ইশরাত জাহান মনি
এডভোকেট, ঢাকা জজ র্কোট।
মোবাইল: ০১৭৮৪৩৯৫৬১৭
ইমেইল: advocateisrat86@gmail.com
টাইমস/এইচইউ