নেপালি নারীদের পিরিয়ড ও করুণ গল্প

 

ইশা নিরলা। একজন নেপালি তরুণী ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী। গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়াতে গেলেই তাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, তার মাসিক বা পিরিয়ড চলছে কিনা?

আর এ প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবারই তাকে মিথ্যে বলতে হয়। কারণ তিনি যদি বলেন যে, তার মাসিক চলছে, তবে তাকে ‘অপবিত্র’ বলে ঘর থেকে আলাদা করে দেয়া হবে।

এমনকি ক্ষুধা লাগলেও তিনি রান্নাঘরে যেতে পারবেন না। মন চাইলেও পরিবারের সবার সঙ্গে বসে টিভি দেখতে পারবেন না।

নেপালি প্রথা অনুযায়ী মাসিকের সময় নারীদের ‘অপবিত্র’ মনে করা হয়। তখন তাদেরকে বাড়িতে আলাদা কুঁড়েঘরে থাকতে হয়। নেপালের গ্রামীণসমাজে প্রচলিত এ প্রথাকে বলা হয় ‘চৌপাডি’।

কেবল ইশা নিরলা নয়, নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণসমাজে এ কুসংস্কারটি এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।

ফলে মাসিকের সময় নারীদের অত্যন্ত দুর্বিসহ ও মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।

ইতোমধ্যে এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথা কেড়ে নিয়েছে শত শত নেপালি নারীর জীবন। তারপরও হিন্দু ধর্মীয় আচার হিসেবে এ নিষ্ঠুর ও অমানবিক কুসংস্কার এখনও নেপালি সমাজে প্রচলিত আছে।

ইশা নিরলা জানান, নেপালের গ্রামীণসমাজে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয়, মাসিকের সময়য় নারীরা ঘরে থাকলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হন। এতে দেবতারা অভিশাপ দেন এবং পরিবারের অমঙ্গল হয়। তাই এ সময় নারীদের বাড়ির বাইরে নির্মিত কুঁড়েঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়।

শুধু তাই নয়, অপবিত্র বলে এ সময় নারীদের সব ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া নিষেধ বলে জানান তিনি।

নেপালি এ নারী আরও জানান, এক্ষেত্রে বাইরের আবহাওয়া বসবাসের উপযোগী কিনা তার কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়িতে চৌপাডি বা কুঁড়েঘর না থাকলে নারীদের গোয়াল ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়। কেবল মাসিকের সময়ই নয়, সন্তান জন্মদানের পরও নারীদের অপবিত্র মনে করে চৌপাডিতে থাকতে বাধ্য করা হয়।

মাসিকের এ সময়টাতে নারীদেরকে পুরুষ ও গরু স্পর্শ করতে দেয়া হয় না। কিছু কিছু খাবারেও আছে বিধিনিষেধ। হাঁটাচলায়ও দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। কিশোরীদের স্কুলে যেতে দেয়া হয় না। কখনো কখনো চৌপাডিতে ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী হামালার শিকার হন এ নারীরা।

তাছাড়া, চৌপাডিগুলো খুবই ছোট ও নিচু। অনেকটা আমাদের দেশের হাঁস-মুরগী বা ছাগল রাখার ছোট ঘরের মতো। চৌপাডিগুলো অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ।

নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণসমাজে এ প্রথাটি অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। ফলে অনেক সময় নারীদের বিভিন্ন করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়।

এমনকি বিভিন্ন সময় চৌপাডিতে থাকতে গিয়ে দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

জাতিসংঘ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার যে সংজ্ঞা দিয়েছে, সেই অনুযায়ী এটিও এক প্রকার নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা।

তাই ২০০৫ সালে চৌপাডি প্রথাকে নিষিদ্ধ করে  নেপালের সুপ্রিমকোর্ট। তারপরও নিষ্ঠুর এ প্রথা বন্ধ হয়নি। এখনও প্রতিনিয়ত এ প্রথার করুণ পরিণতির গল্প শোনা যায়।

এই তো সেদিন ৯ জানুয়ারি (বুধবার) নেপালের বাজুরা জেলার ঘটনা। মাসিকের চলাকালে চৌপাডিতে থাকার সময় দুই ছেলে সন্তানসহ মারা যান নেপালের এক নারী।

বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাসিক চলার কারণে এ নারীকে দুই সন্তানসহ বাড়ির বাইরে চৌপাডিতে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন বাইরে ছিল প্রচণ্ড শীত। শীত থেকে বাঁচতে তিনি আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। আগুনের ধোঁয়ায় ঘুমের মধ্যেই শ্বাসরোধ হয়ে দুই সন্তানসহ এ নারী মারা যান বলে নেপালি কর্মকর্তাদের ধারণা।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর নেপালের পশ্চিমাঞ্চলীয় অচাম জেলায় ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। মাসিক চলাকালে কুঁড়ে ঘরে থাকার সময় দম বন্ধ হয়ে সে মারা যায় বলে জানা যায়।

একইভাবে মাসিক চলাকালে চৌপাডিতে থাকার সময় সাপের কামড়ে মারা যায় আরেক কিশোরী। ফলে চৌপাডি প্রথার কারণে নেপালি নারীদের মৃত্যুর গল্প এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

২০১৭ সালে প্রণীত নেপালের আইন অনুসারে, নারীদের চৌপাডিতে রাখতে বাধ্য করা একটি অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে তিন মাস কারাদণ্ড এবং তিন হাজার নেপালি রুপি অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, জনসচেতনতার অভাব ও আইনটির কঠোর প্রয়োগ না থাকায় নেপালের গ্রামীণসমাজে এখনও এ কুসংস্কারের প্রচলন রয়ে গেছে।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ম্যাচসেরা হওয়ার পর মুখ খুললেন সাইফ হাসান Sep 21, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Sep 21, 2025
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর চেতনার ব্যবসা আর চলবে না : সালাহউদ্দিন আহমেদ Sep 21, 2025
হবু স্ত্রীকে নিয়ে হান্নানকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে অপপ্রচার! Sep 21, 2025
৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনকে ৭১ সালের দায় দেয়া হয়;আকাশ দাস Sep 21, 2025
শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মবিরতি নিয়ে যা বললেন ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী এষা Sep 21, 2025
img
কেইনের হ্যাটট্রিকে হফেনহাইমকে উড়িয়ে বায়ার্নের চারে চার Sep 21, 2025
কেউ যেন বিএনপির নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে না পারে- তারেক রহমান Sep 21, 2025
img
দুর্গাপূজার আগেই সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি Sep 21, 2025
img
গভীর রাতে ভিসির বাসভবনের সামনে থেকে সরলেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা Sep 21, 2025
img
আলোচনা চলাকালে রাজপথে নামা দ্বিচারিতা: সালাহউদ্দিন আহমদ Sep 21, 2025
img
সরকারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ঢালাও মামলা ও মব: সালাহউদ্দিন Sep 21, 2025
img
দেশের স্বার্থে সবাইকে সংকীর্ণ ও হিংস্র দলীয়পনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে : ঢাবি উপাচার্য Sep 21, 2025
img
কুষ্টিয়ায় বজ্রপাতে প্রাণ গেল দুইজনের Sep 21, 2025
img
রোববার থেকে রাজপথে নামছেন ফিলিপাইনের মানুষ Sep 21, 2025
img
তাসকিন-মুস্তাফিজের কারণে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়নি: শানাকা Sep 21, 2025
img
দুর্গাপূজায় সর্বত্র নিরাপত্তায় পাশে থাকবে বিএনপি : আব্দুস সালাম আজাদ Sep 21, 2025
img
১২ ম্যাচ কম খেলেই সাকিবের রেকর্ডে ভাগ বসালেন ‘ফিজ’ Sep 21, 2025
img
আন্দোলনের চাপে স্থগিত পোষ্য কোটা, তবে বাতিলের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা Sep 21, 2025
img
সাকিবকে পেছনে ফেলে লিটনের নতুন রেকর্ড Sep 21, 2025