লেনিন: বলশেভিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। একজন রাশিয়ান বিপ্লবী। বলশেভিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ। তিনিই হলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক। তার নেতৃত্বেই ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট সরকারের গোড়াপত্তন হয়।

তার প্রতিষ্ঠিত কমিউনিজম লেলিনবাদ হিসেবে পরিচিত। লেনিন ১৮৭০ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সিমবিরস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং শৈশবেই ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা শিখেছিলেন।

রাশিয়ার সম্রাটের (জার) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১৮৮৭ সালে তাকে কেজান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর তিনি বাসায় নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা করতে লাগলেন। ১৮৯১ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার লাইসেন্স পেয়ে যান।

একই বছরে রুশ সম্রাট আলেকজান্ডার তৃতীয়কে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে লেনিনের ভাই আলেক্সান্ডারকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং তার বোন আনাকে তাতারস্তানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে ভাই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেন লেনিন।

সেন্ট পিটার্সবার্গে আইন অধ্যয়ন করার সময় তিনি জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঞ্জেলসের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হন। পুঁজিবাদকে উৎখাত করে একটি সাম্যবাদী কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন লেনিন।

তিনি বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজকে অন্তর্নিহিতভাবে অবিচার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মার্কসবাদের সমর্থন ও পুঁজিবাদের সমালোচনা করায় তাকে গ্রেপ্তার করে সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠানো হয়।

১৮৯৯ সালে কারাগারে থাকাকালে তিনি “দ্য ডেভেলাপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজম ইন রাশিয়া” নামে বই লিখেন। ১৯০০ সালে লেনিন কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বের হন এবং মার্ক্সবাদের সমর্থনে “ইস্করা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেন।

এ সময় পার্টির আরেকজন নেতা জুলিয়াস মার্টোভের সাথে লেনিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এতে দলটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি শাখা লেনিনের নেতৃত্বে যার নাম ‘বলশেভিক’। এই দলটি চূড়ান্ত ক্ষমতা সরকারের হাতে দিতে চেয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে লেনিনের নেতৃত্বে মার্কসবাদী বলশেভিক নেতারা বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।

১৯১৭ সালে লেনিনের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ায় যে তিনি জার্মানির কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন। এতে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন লেনিন। তিনি গ্রেপ্তার ও হত্যার ভয়ে ফিনল্যান্ডে পালিয়ে যান। সেখানে থেকেই তিনি তার কমিউনিজম নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

এসময় ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে’র ফলে রাশিয়ার জার নিকোলাস দ্বিতীয়র পতন হয়। এতে জার্মানির সহযোগিতায় লেনিন রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি সরকারবিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যান।

১৯১৭ সালের অক্টোবরে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবীরা কেরোনস্কি সরকারকে উৎখাত করে পেট্রোগ্রাদসহ (সেন্ট পিটার্সবার্গ) রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো দখল করে নেয়। ইতিহাসে এটি ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামে পরিচিত।

সফল বিপ্লবের পর লেনিন রাশিয়াকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তিনি এর প্রধান নেতা নিযুক্ত হন। লেনিন ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে জার্মানির সাথে চুক্তি করে যুদ্ধের ইতি টানেন। যদিও এই যুদ্ধে অনেক ভূখণ্ড হারিয়ে রাশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

জার্মানির সাথে রাশিয়ার এই চুক্তির ফলে মিত্রশক্তি বৃটেন ও ফ্রান্স ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। তাদের আশংকা রাশিয়ায় কমিউনিস্টদের উত্থান সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে। তাই তারা রাশিয়ার লেনিনবিরোধীদের সমর্থন দিতে থাকে। ফলে রাশিয়ায় গৃহ যুদ্ধ দেখা দেয়।

এ সময় বিরোধীদের দমন করতে বিশেষ খাদ্যনীতি চালু করেন তিনি। এর ফলে রাশিয়ার অসংখ্য সাধারণ নাগরিক দুর্ভিক্ষ ও রোগে মারা যায়। এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং লেনিনের বলশেভিক দল বিজয়ী হয়।

যুদ্ধ শেষ হলে লেনিন নতুন অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি চালু করেন। তিনি সীমিত আকারে ব্যক্তিখাতে উদ্যোক্তাদের সুযোগ দেন।

১৯২৪ সালে ২১ জানুয়ারি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এই বলশিভিক নেতা মারা যান। মস্কোর রেড স্কয়ারে তার নামে ‘লেনিন মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এখানেই লেনিনের মরদেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

তার স্মৃতির সম্মানে ১৯২৪ সালে পেট্রোগ্রাদের (সাবেক সেন্ট পিটার্সবার্গ) নাম পরিবর্তন করে লেনিনগ্রাদ রাখা হয়। তার মৃত্যুর পর রাশিয়ার ক্ষমতায় আসেন আরেক বিপ্লবী নেতা স্ট্যালিন।

Share this news on:

সর্বশেষ

img

ডাকসুর বিবৃতি

তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে বিএনপি Nov 03, 2025
img
বৃথা গেলো ভলভার্টের সেঞ্চুরি, আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ী ভারত Nov 03, 2025
img
কাস্টমস কর্মকর্তা শহিদুজ্জামান বরখাস্ত Nov 03, 2025
img

টেবিল টেনিস

থাই কোচের বিদায়, ইরানি কোচ আনতে চায় বাংলাদেশ Nov 03, 2025
img
১১ দেশে প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন চলছে Nov 03, 2025
img
৪ দিনের পূর্বাভাসে লঘুচাপ নিয়ে নতুন তথ্য Nov 03, 2025
img
আরও ১০০ বছর রাজত্ব করো- শাহরুখকে ফারাহ Nov 02, 2025
img
বিএনপিকে আলোচনায় বসতে জামায়াতের আহ্বান Nov 02, 2025
img
রাজধানীতে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৪ Nov 02, 2025
img
১৬ বছর পর আমন্ত্রণ ফেরানোর পর এবার বিটিভিতে গেলেন আসিফ Nov 02, 2025
img
নতুন রূপে শাহরুখ, ‘কিং’ সিনেমার টাইটেল ট্র্যাকে মুগ্ধ দর্শক Nov 02, 2025
img
ভুল করে গোল খাওয়ার পর আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজের মন্তব্য Nov 02, 2025
img
ট্রাম্পের কড়া বার্তাকে ‘স্বাগত’ জানাল নাইজেরিয়ার সরকার Nov 02, 2025
img
‘শাপলা কলি’ পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনসিপি নেতাকর্মীদের পোস্ট Nov 02, 2025
img
আগে ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ, তারপর এলডিসি থেকে উত্তরণ : আমীর খসরু Nov 02, 2025
img
প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি, পরিবারসহ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ৬ জনের সাক্ষ্য Nov 02, 2025
img
ভারতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল অন্তত ১৮ জনের Nov 02, 2025
img
সবচেয়ে ভারী স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছে ভারত Nov 02, 2025
img
৪ মাসে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠালেন ১০.১৪ বিলিয়ন ডলার Nov 02, 2025
img
রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটাতে হাতপাখার বিকল্প নেই : ফয়জুল করীম Nov 02, 2025