আজিজুল হক: আঙ্গুলের ছাপ উদ্ভাবনকারী বাঙালি

ব্যক্তি সনাক্তকরণে বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি হল ফিঙ্গার প্রিন্ট (আঙ্গুলের ছাপ)। আমাদের অনেকেই জানি না যে, এই অভূতপূর্ব উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে এক সাধারণ বাঙালির নাম। তিনি হলেন খান বাহাদুর কাজি আজিজুল হক। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ কর্মকর্তা স্যার এডওয়ার্ড রিকার্ড হ্যানরির তত্ত্বাবধানে কাজ করার সময় তিনি আঙ্গুলের ছাপের গাণিতিক শ্রেণিবিন্যাস উদ্ভাবন করেছিলেন।

আঙ্গুলের ছাপ বর্তমানে অপরাধী সনাক্তকরণে বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। তবে আরও বিভিন্ন কাজে এই পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে ব্যক্তির জীবনযাত্রা, তার বসবাসরত পরিবেশ, তার কাজ-কর্ম, খাওয়ার অভ্যাস, অন্যান্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কেও তথ্য জানা যায়।

এমনকি আপনি চুলে কোনো জেল ব্যবহার করেছেন, কনডম ব্যবহার করেছেন কিনা, কিংবা আপনি মাদক বা অ্যালকোহল গ্রহণ করেছেন কিনা ইত্যাদি তথ্যও আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে জানা যায়। আর এই আঙুলের ছাপ উদ্ভাবনের মূল কৃতিত্ব ছিল উনিশ শতকের বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা কাজি আজিজুল হকের।

১৮৭২ সালে ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশের) খুলনা জেলার ফুলতলার পয়োগ্রাম কসবায় জন্মগ্রহণ করেন আজিজুল হক। তার পারিবারিক নাম ছিল কাজি সৈয়দ আজিজুল হক।

শৈশবেই তিনি এক নৌ দুর্ঘটনায় বাব-মাকে হারান। এরপর ১২ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে স্থানীয় একটি পরিবারে তার আশ্রয় হয়। গণিতের উপর তার ভালো দক্ষতা দেখে ওই পরিবার খুব অনুপ্রাণিত হয় এবং তাকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করে দেয়। পরে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন।

২০০১ সালে প্রকাশিত কলিন বিভানের ফিঙ্গার প্রিন্ট বিষয়ক একটি গ্রন্থে বলা হয়, ১৮৯২ সালে ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এডওয়ার্ড হেনরি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের কাছে একটি চিঠি লিখেন এবং পরিসংখ্যানের উপর ভালো দক্ষতা আছে এমন একজন শিক্ষার্থী দিতে বলেন। এক্ষেত্রে কলেজ অধ্যক্ষ গণিতের মেধাবী ছাত্র কাজি আজিজুল হকের নাম সুপারিশ করেন।

হ্যানরি আজিজুল হককে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ দেন। এভাবে বেঙ্গল পুলিশ সার্ভিসে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার পৃথক হলে তিনি বিহার পুলিশে যোগ দেন।

পুলিশ সার্ভিসে কাজ করার সময় হেনরি কর্তৃক আজিজুল হককে অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানব দেহের আকৃতি) পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মূলত ওই সময় পুলিশ বিভাগে অপরাধী সনাক্তকরণে অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানব দেহের আকৃতি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হত।

কিন্তু ফ্রান্সিস গাল্টন কর্তৃক উদ্ভাবিত এই অ্যানথ্রোপমেট্রি পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে তিনি হতাশ হন। এসময় গ্লাটনের উদ্ভাবিত পদ্ধতির কিছু উপাদানের উপর ভিত্তি করে আজিজুল হক নিজের উদ্ভাবিত কিছু পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন।

কলিন বিভানের গ্রন্থে বলা হয়, অ্যানথ্রোপমেট্রি পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে আজিজুল হক ভীষণ অসুবিধায় পড়েন। ফলে তিনি নিজেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাস করণের একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন।

তিনি একটি বিশেষ গাণিতিক ফর্মুলা আবিষ্কার করেন। এই ফর্মুলার আলোকে তিনি আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ৩২টি থাক বানান। সেই ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করেন এক হাজার ২৪টি খোপ। এভাবে তিনি তার কর্মশালায় সাত হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তাঁর সহজ-সরল এই পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংখ্যায় লাখ লাখ হলেও শ্রেণীবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দেয়।

জানা যায়, ওই সময় আজিজুল হকের সঙ্গে আরেকজন ভারতীয় আঙুলের ছাপের টেলিগ্রাফিক কোড পদ্ধতি উদ্ভাবনে সাহায্য করেছিলেন। তার নাম হেম চন্দ্র বোস। আর তাদের কাজের সুপারভাইজার ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড হ্যানরি।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রথমে হ্যানরি এই উদ্ভাবনের আনুষ্ঠানিক কৃতিত্ব এই দু’জনের কাউকেই দেননি। তিনি এই পদ্ধতিটি ব্রিটেনে প্রকাশ করেন। ব্রিটেন সরকার হ্যানরিকে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করে। আর আজিজুল হকের উদ্ভাবিত আঙুলের ছাপের শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি ‘Henry Classification System of fingerprints’ নামে পরিচিত হয়।

যাইহোক কয়েক বছর পরে আঙুলের ছাপ আবিষ্কারের জন্য স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেন আজিজুল হক। পরে স্যার হেনরি আনুষ্ঠানিকভাবে এই দু’জন পুলিশ অফিসারের অবদানের কথা স্বীকার করেন।

পরে এ বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা ও লেখালেখি হয়। ১৯৬৫ সালে বেঙ্গল পুলিশের সাবেক আইজি (১৯৩৮-৪২) চন্দক সেনগুপ্ত টাইম ম্যাগাজিনকে লিখা এক চিঠিতে আঙুলের ছাপ উদ্ভাবনে আজিজুল হকের অবদানের বিষয়টি তুলে ধরেন। এভাবে আরও অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরেন।

একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার আজিজুল হকের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেয় এবং তাকে ১৯১৩ সালে খান সাহেব (যা পরে ১৯২৪ সালে খান বাহাদুর হয়ে যায়) উপাধি দেয়া হয়।

পুরস্কার স্বরূপ তাকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটি জায়গির দেয়া হয়। পরে তিনি চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হয়েছিলেন।

এছাড়া ব্রিটেনের ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি’ খান বাহাদুর আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বোসের নামে একটি গবেষণা পুরস্কার চালু করে। ফরেনসিক বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রাখেন তাদেরকেই এ পুরস্কার দেয়া হয়।

অবশেষে ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত ভারতের চম্পারানে মারা যান বাংলার কৃতি সন্তান খান বাহাদুর আজিজুল হক।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পাকিস্তানের সংবিধান পরিবর্তন, সেনাপ্রধান পেলেন গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন মুক্তি Nov 15, 2025
img

মঞ্জুরুল আলম পান্না

সাংবাদিকতার পুরস্কার হিসেবে পেলাম ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ Nov 15, 2025
img
জীবনের চ্যালেঞ্জ থেকে শিখেছি বিনয় : ইমরান হাশমি Nov 15, 2025
img

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ৯ দিনের জন্য বিশেষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামবে Nov 15, 2025
img
নারী কাবাডি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করল বাংলাদেশ Nov 15, 2025
img
দাদুর জীবনী পড়ে জেনেছি, কত পরিশ্রম করলে 'ফ্লপ মাস্টার জেনারেল' তকমা সরিয়ে মহানায়ক হওয়া যায় Nov 15, 2025
img
শেহনাজ গিলের স্বামীর জন্য মিউজিক্যাল শর্ত Nov 15, 2025
img
নিরাপত্তা উপদেষ্টার ভারত সফর আঞ্চলিক শান্তির প্রয়াস: মুশফিকুর রহমান Nov 15, 2025
img
জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন থেকে একদম বাইরে রাখা সমীচীন নয়: জিএম কাদের Nov 15, 2025
img
স্থগিত নয়, বাতিল জেমস-আজমতের কনসার্ট Nov 15, 2025
img
সোহানের রেকর্ডগড়া সেঞ্চুরিতে হংকংকে ৮ উইকেটে হারাল টাইগাররা Nov 15, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থ হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরিও বাধাগ্রস্ত হবে: বিআরটিএ চেয়ারম্যান Nov 15, 2025
img
ফি জমা দিতে পারিনি- কারিশমার সন্তানদের আকুতিকে ‘নাটক’ বলে আখ্যা হাইকোর্টের Nov 15, 2025
img
আল্লাহ যখন কিছু লিখে রেখেছেন, সেটা ঘটবেই: বাবর আজম Nov 15, 2025
img
নওগাঁয় বিএনপি নেতা বহিষ্কার Nov 15, 2025
img
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র অভিনেত্রী ভদ্রা আর নেই Nov 15, 2025
img
স্ত্রীর মামলায় গ্রেপ্তার হলেন হিরো আলম Nov 15, 2025
img
ভালোবাসা আর মানবতাই মানুষকে মহান করে: মিঠুন চক্রবর্তী Nov 15, 2025
img
ছেলেবন্ধুদের দেখেছি বাবার সঙ্গে খুব একটা বনিবনা নেই : সোহিনী Nov 15, 2025
img
নাগরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব : ডিএসসিসি প্রশাসক Nov 15, 2025