হাজী শরীয়তুল্লাহ : সমাজ সংস্কারক ও সংগঠক

হাজী শরীয়তুল্লাহ, বাংলার একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক, সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী। ইসলাম ধর্মের নামে বাংলার সমাজে প্রচলিত নানা কর্মকাণ্ড সংস্কারের উদ্দেশ্যে উনিশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ইংরেজ ও নীলকরদের কর্তৃক নিপীড়নের শিকার বাংলার কৃষকদের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক অন্যতম পথপ্রদর্শক।

১৭৮১ সালে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) শামাইল গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে হাজী শরিয়তুল্লাহর জন্ম। তার বাবা আব্দুল জলিল তালুকদার ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। আট বছর বয়সেই তিনি বাবাকে হারান। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং বারাসাত আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এরপর তিনি মুর্শিদাবাদে চলে যান এবং ফুরফুরার স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন।

১৭৯৯ সালে আঠারো বছর বয়সে তিনি তার শিক্ষক বাশারত আলীর সঙ্গে মক্কা গমন করেন। এ সময় তিনি আরবি ও ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হন। এরপর তিনি কিছুদিন মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। আরবে থাকাকালে বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবিদদের থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। যা তাকে একটি উত্তম ও সম্মানজনক জীবন পেতে উদ্বুদ্ধ করে।

প্রায় দুই দশক তিনি আরবে ছিলেন। এ সময় আরবে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব কর্তৃক পরিচালিত ওয়াহাবী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। আরবের চারদিকে ইসলামী পুনরুজ্জীবনের ধর্মীয় উদ্দীপনার জয়জয়কার। আর এই বিপ্লবী উদ্দীপনাকে সঙ্গে নিয়ে ১৮১৮ সালে দেশে ফিরেন শরীয়তুল্লাহ।

দেশে ফিরে তিনি ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়গুলো প্রচারে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু এ সময় তার এই মৌল মতবাদের প্রচারণা মুসলমানদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তিনি আবার মক্কায় গমন করেন এবং তার শিক্ষাগুরু তাহিরের কাছ থেকে ইসলামের মৌলিক আদর্শের আলোকে সমাজে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার অনুমতি নিয়ে ১৮২০ সালে আবার দেশে ফিরে আসেন।

তিনি এমন এক সময় দেশে ফিরে আসেন যখন সমগ্র বাংলার জনগণ নীলকরদের নির্যাতন ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত। ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, স্থানীয় জমিদার, নীলকর ও তাদের সহযোগীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিল সমগ্র বাংলা। তাদের হিংস্রতা ও বর্বর অত্যাচারে বাংলার কৃষকরা মধ্যযুগীয় ইউরোপের ক্রীতদাসদের পর্যায়ে পরিণত হয়। বাংলার কৃষকদের এই করুণ অবস্থা শরীয়তুল্লাহকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে।

অন্যদিকে তিনি দেখতে পেলেন তৎকালীন বাংলায় ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। তিনি এসব কুসংস্কারকে শিরক ও বিদআত বলে প্রচারণা করলেন। তার এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল এসব শিরক ও বিদআতী কর্মকাণ্ড থেক মুসলমানদেরকে বিরত রাখা। এজন্য তিনি ইসলামের মৌলিক ও অবশ্য পালনীয় (ফরজ) বিধানগুলো মেনে চলতে প্রচারণা চালাতে থাকেন। তার এই প্রচারণা ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

তিনি ইসলামের অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্য বা ‘ফরজ’ পালনের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। তিনি সব মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববোধ ও একতা এবং সব মানুষের সমতার ওপর জোর দেন। তিনি শ্রেণি বৈষম্যের নিন্দা করেন। প্রথম দিকে তার এই সংস্কার আন্দোলন ফরিদপুর অঞ্চলে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশালসহ বাংলার দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় হিন্দু জমিদাররা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য মুসলমানদের উপর কর দাবি করত। শরীয়তুল্লাহ জমিদারদের এ ধরণের কর না দিতে তার অনুসারীদের আহবান জানান। তার মতে, কেবল সরকার নির্ধারিত কর প্রদান করা যাবে। মুসলমানরা তার আহবানে সাড়া দিয়ে কর দিতে অপারগতা জানালে জমিদার ও ইংরেজদের সঙ্গে শরীয়তুল্লাহর অনুসারীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ব্রিটিশদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এ দেশকে তিনি ‘দারুল হারব’ বা ‘শত্রু রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে একপর্যায়ে শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। তিনি দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হবার আহবান জানান। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে তার এই আন্দোলন এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, শরীয়তুল্লাহ নিজস্ব একটি রাজ্য গড়ে তুলতে পারেন হিন্দু জমিদারদের মধ্যে এমন আশংকা তৈরি হয়।

ফলে একপর্যায়ে হিন্দু জমিদার, নীলকর ও ইংরেজরা মিলে একজোট হয়ে শরীয়তুল্লাহকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ, বেশ কয়েকবার ইংরেজ পুলিশের হাতে আটক হতে হয়েছে তাকে। তারপরও তিনি তার আন্দোলনে অবিচল ছিলেন।

চল্লিশের দশকে ফরায়েজী আন্দোলনে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল যখন উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই ১৮৪০ সালে শরীয়তুল্লাহ মারা যান। তার মৃত্যুর পর ছেলে মহসিন উদ্দীন (দুদু মিয়া) ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জমিদারদের সমালোচনা করে দুদু মিয়া তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন- “জমি থেকে খাজনা আদায় আল্লাহর আইনের পরিপন্থী”।

বাংলার সমাজ সংস্কার ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শরীয়তুল্লাহর নামে ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১০ মার্চ তার নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে ডাক বিভাগ। এছাড়া মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর নির্মিত সেতুটির নামকরণ হয়েছে শরীয়তুল্লাহর নামে।

হাজী শরীয়তুল্লাহ কেবল একজন ধর্মীয় সংস্কারকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিশারী। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি এবং ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে তার অবদান যুগ যুগ ধরে স্মরণকরবে বাংলার মানুষ।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে : নাহিদ ইসলাম Jul 05, 2025
img
এনসিপির কর্মসূচি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনে একটি নতুন রাজনীতির সূচনা: প্রেস সচিব Jul 05, 2025
img
সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করা হবে: আখতার Jul 05, 2025
img
এজবাস্টনে বড় লিড নিয়ে তৃতীয় দিন শেষ করল ভারত, চাপে ইংল্যান্ড Jul 05, 2025
img
৬ ঘণ্টা পর খুলনা রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক Jul 05, 2025
img
মুন্সীগঞ্জে বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল ২ মোটরসাইকেল আরোহীর Jul 05, 2025
img
হাসারাঙ্গাকে সামলানোর নতুন কৌশল খুঁজে পেল বাংলাদেশ! Jul 05, 2025
img
সংস্কার শেষে এই সংবিধানের অধীনেই দেশ চলবে: রিজভী Jul 04, 2025
img
আওয়ামী লীগ শুধু হিন্দুদের ব্যবহার করেছে মাত্র: আযম খান Jul 04, 2025
img
আগস্টে তুরস্কের বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ নারী দল! Jul 04, 2025
img
ধূমপানের দৃশ্য নয়, নীতির কাছে আপসহীন অভিনেত্রী রাশমিকা! Jul 04, 2025
img
খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক তুলে নিল রাজস্ব বোর্ড Jul 04, 2025
img
বিএনপি জনগণের রাজনীতি করে, ক্ষমতার রাজনীতি করে না: ওবায়দুর রহমান চন্দন Jul 04, 2025
img
‘রামায়ণ’ হতে যাচ্ছে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমা Jul 04, 2025
img
দেশে টানা ৫ দিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস Jul 04, 2025
১০ মিনিটে সারাদিনের দেশের আলোচিত সব খবর Jul 04, 2025
img
সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে না পারা : শিবির সভাপতি Jul 04, 2025
img
জুলাই যোদ্ধাদের সনদ দেওয়া সম্ভব কিন্তু একটু ক‌ঠিন : উপদেষ্টা শারমীন Jul 04, 2025
img
অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় উন্মাদনা ছড়াচ্ছে ‘ওয়ার ২: প্রথম শো ভোর পাঁচটায় Jul 04, 2025
img
ভারতের আধিপত্য রুখতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে : আব্দুস সালাম Jul 04, 2025