ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রুশ সামরিক বাহিনীর এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ সদস্য হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে গত মাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আনুমানিক ৮০ হাজার সদস্য নিহত এবং ৪ লাখ আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ না করায় ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে লক্ষাধিক বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছেন এবং লক্ষাধিক বাড়িঘর ও অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধের কারণে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, যা মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছে।
এই যুদ্ধটি দু'পক্ষের জন্যই অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। রাশিয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিনিয়োগ করেও প্রথাগত যুদ্ধের মাধ্যমে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে পারছে না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা অস্ত্র ও সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন।
এত দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলার অন্যতম কারণ হিসেবে উভয় পক্ষের কোনো ধরনের সমঝোতায় যাওয়ার অনিচ্ছা এবং অক্ষমতাকে দায়ী করা হচ্ছে। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, আগামী বছর (সংঘাত নিরসন) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আসতে পারে। তবে এই যুদ্ধ কখন শেষ হতে পারে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
এটি সাম্প্রতিক সময়ের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাণঘাতী অস্ত্র এবং কৌশলগত ব্যবহার বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই যুদ্ধে রাশিয়া এবং ইউক্রেন দু'পক্ষই আধুনিক এবং বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, বিধ্বংসী ট্যাংক, ড্রোন এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত অস্ত্র।
রুশ অস্ত্র ভাণ্ডার: রাশিয়ার অন্যতম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কিঞ্জাল শব্দের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দ্রুতগতির। সম্প্রতি এর ব্যবহার ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্রা নিয়ে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার বা গভীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাতেও আঘাত হানতে সক্ষম।
স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য সুপরিচিত। ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনা এবং বিদ্যুৎ অবকাঠামো সুনির্দিষ্টভাবে ধ্বংস করার জন্য এসব ব্যবহার করা হয়েছে। অত্যাধুনিক টি-৯০ ট্যাংক উন্নত সুরক্ষা এবং আক্রমণাত্মক ক্ষমতা দিয়ে সুসজ্জিত। ইরানের তৈরি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন বা 'কামিকাজে ড্রোন' ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ইউক্রেনের অস্ত্র ভাণ্ডার: যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া হিমার্স রকেট সিস্টেম নির্ভুলভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম এবং দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার জন্য বিখ্যাত। জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক রাশিয়ার বিধ্বংসী ট্যাংকগুলোর মোকাবিলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের দেয়া স্টর্ম শ্যাডো ক্রুজ মিসাইল বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মাঝারি দূরত্বে যেকোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে অত্যন্ত কার্যকর। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে, যা ইউক্রেনের আকাশসীমা সুরক্ষায় কার্যকর।
গাজা-লেবানন যুদ্ধের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের তুলনা: ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সম্প্রতি ভয়াবহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো গাজা ও লেবানন যুদ্ধে ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক এবং প্রাণঘাতী। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ড এবং লেবাননে ব্যবহৃত রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত স্বল্প-পাল্লার যেমন কাসাম বা ফজর-৫ রকেট। এগুলো তুলনামূলকভাবে সস্তা, কম প্রযুক্তিগত এবং মূলত শত্রুর শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যই মূলত ব্যবহৃত হয়।
অপরদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো প্রযুক্তিগতভাবে অনেক অত্যাধুনিক এবং নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদে সক্ষম। রুশ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বা ইউক্রেনে মার্কিন হিমার্স সিস্টেম অনেক বেশি বিধ্বংসী কারণ এগুলো নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম এবং মুহূর্তে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
শেষ মুহূর্তে কেন বাইডেনের এমন দৌরাত্ম্য: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এমন সব বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারে কেন ইউক্রেনকে অনুমতি দিচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্বের অনেকের মনে শঙ্কা জেগেছে। ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র চায় রুশ আধিপত্যবাদ দমিয়ে রাখতে। এরই অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে শক্তিশালী করে রাশিয়াকে দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করার কৌশল নেয়া হয়েছে। ইউক্রেনকে সহায়তার মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন সামরিক জোট ন্যাটো জোট ও এর মিত্রদের শক্ত অবস্থান দেখাতে চায়। নির্বাচনের হেরে যাওয়ার পরেও বাইডেন প্রশাসন প্রমাণ করতে চায় যে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে এসব অস্ত্র সরবরাহ এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে এবং পরমাণু সংঘাতের শঙ্কা বাড়াচ্ছে বলে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নামে পরিচিত যা শুরু হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে যেদিন ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এটি একটি বড় আকারে যুদ্ধের সূচনা করে যা ২০১৪ সাল থেকে চলমান উত্তেজনার ফল। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর এবং পূর্ব ইউক্রেনে (ডনেটস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে এই উত্তেজনা শুরু হয়েছিল। তবে ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালের আক্রমণ সংঘাতকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং ইউক্রেনজুড়ে তীব্র যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মানবিক বিপর্যয় এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।