শ্রীলঙ্কায় হামলা চালানো গ্রুপটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

রোববার ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা, তিনটি হোটেলসহ অন্তত আটটি স্থানে পরপর বোমা হামলায় অন্তত ২৯০ জন নিহত হয়েছেন।  আন্তর্জাতিক এক নেটওয়ার্কের সহায়তায় স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন। হামলায় আরো অন্তত ৫০০ জন আহত হয়েছেন। খবর বিবিসির।

নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতিও রয়েছে। এছাড়া সেলিমের জামাতাও হামলায় আহত হয়েছেন।

এই হামলার জন্য স্থানীয়ভাবে অচেনা একটি জিহাদি গ্রুপ, ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত দায়ী বলে মনে করছে শ্রীলঙ্কার সরকার। ফলে তদন্তকারীরা এখন এই গ্রুপটির প্রতি বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন। যদিও কোনো গোষ্ঠী এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেনি।

এই গ্রুপটি সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?

শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা বলছেন, এরা স্বল্প পরিচিত নতুন একটি গোষ্ঠী, যাদের সম্পর্কে কিছুদিন আগেও তেমন একটা জানা ছিল না। কিছুদিন আগে একটি বুদ্ধ ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনার সঙ্গে এই গ্রুপটি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়।

বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে ২০১৬ সালে গোষ্ঠীটির একজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর প্রথম এটি আলোচনায় আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত গ্রুপটি ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী ধ্যানধারণা লালন করে।

শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম বলছে, এই গ্রুপটি কাট্টাকুডি নামের একটি মুসলিম অধ্যুষিত শহরে ২০১৪ সালে গঠিত হয়। তবে এর আগে মারাত্মক কোনো হামলার চালানোর সঙ্গে এদের নাম শোনা যায়নি। তবে দলটি তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গ্রুপকে সমর্থন করতো বলে জানা যাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ

অ্যালান কিনান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শ্রীলঙ্কা বিষয়ক পরিচালক। তিনি ধারণা দিচ্ছেন, ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত সম্ভবত সেই গোষ্ঠী, যারা গত বছরের একটি 'ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ'  ঘটনায় জড়িত ছিল।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরে মারওয়ানেলা শহরে বুদ্ধের কয়েকটি মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছিল এবং এরপর পুলিশ কয়েকজন তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল, যারা একজন ধর্মপ্রচারকারীর ছাত্র ছিলেন বলে বলা হয়েছে। এই ধর্মপ্রচারকারীর নাম যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তা রোববারই বেরিয়েছে।’

শ্রীলঙ্কার ওই হামলার দায়দায়িত্ব এখনো কেউ স্বীকার করেনি। দেশটির সরকারও নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি ঠিক কারা ওই হামলা করেছে। দেশটির সরকার ইতোমধ্যেই অন্তত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

আগাম সতর্কবার্তা

১০ দিন আগে ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতের দ্বারা চার্চে হামলার ব্যাপারে "বন্ধুপ্রতীম একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা’ শ্রীলঙ্কার পুলিশকে সতর্ক করেছিল বলে দেশটির স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে। তাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মনোযোগ এখন ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতের দিকেই বেশি।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দি স্টাডি অব ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম-এর পরিচালক অ্যানি স্পেকহার্ড বলছেন, এই গ্রুপটির উদ্দেশ্য কোনো বিপ্লব করা নয়, তাদের আসল উদ্দেশ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের জিহাদীদের আন্দোলনকে শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে দেয়া এবং সমাজে ঘৃণা, ভয় ও বিভেদ তৈরি করা।

স্পেকহার্ড জানান, রোববার একসঙ্গে চার্চ ও বিদেশি পর্যটক অধ্যুষিত হোটেলে হামলা চালানো হয়েছে, যার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বড় বড় ইসলামপন্থী জঙ্গি গ্রুপগুলোর হামলার মিল রয়েছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রোহান গুনারত্না বলেছেন, ইসলামিক স্টেট(আইএস) গ্রুপের শ্রীলঙ্কার শাখা হচ্ছে ওই ছোট সংগঠনটি, যারা চরমপন্থীদের হয়ে লড়াই করতে সিরিয়া আর ইরাকেও গিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগ

শ্রীলঙ্কার সরকার বা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বোমা হামলাগুলোর সঙ্গে স্থানীয় গ্রুপ জড়িত থাকলেও তারা আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, হামলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, ইসলামিক স্টেট অথবা আল কায়েদা এগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

ইতোমধ্যে এই হামলাকে সমর্থন করে আইএস জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবেই এই হামলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিল টাইগাররা আত্মঘাতী হামলাকে এক প্রকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। সে সময় সরকারি কর্মকর্তা ও স্থাপনা লক্ষ্য করে আত্মঘাতী হামলা করা হতো। কিন্তু গির্জা এবং হোটেলে হামলার ঘটনা শ্রীলঙ্কায় একেবারে নতুন।

কেবিনেট সেক্রেটারি রাজিথা সেনারত্নে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘দেশের ভেতরে থাকা একদল ব্যক্তি এসব হামলা করেছে এটা আমরা বিশ্বাস করি না। এখানে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আছে, যাদের ছাড়া এ হামলা সফল হত না।’

এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদের ধরতে অন্যান্য দেশের সহায়তা চেয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।

অ্যান্টি টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ আলটো লাবেটুবান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে মেলালে দেখা যায় ইসলামিক স্টেট এবং আল কায়েদার সঙ্গে এসব হামলার মিল রয়েছে। যে মাত্রায় হামলাটি করা হয়েছে, তাতে আমার মনে হয় না যে শুধুমাত্র স্থানীয়রা এটি ঘটিয়েছে। সম্ভবত বিদেশি গ্রুপ বা লোকজন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে ভারত বা পাকিস্তান থেকে লোকজন আসতে পারে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলছেন, ‘যারা এই হামলা চালিয়েছে,তাদের বিশেষ অপারেশন ক্ষমতা আর দক্ষ কমান্ডার রয়েছে তা বোঝা যায়।’

প্রেসিডেন্ট দপ্তর জানিয়েছে, গোয়েন্দা তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শ্রীলঙ্কান জঙ্গিদের সঙ্গে বিদেশি সন্ত্রাসী চক্র জড়িত রয়েছে।

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সালমান খানের বাড়িতে হামলায় অভিযুক্ত তরুণের আত্মহত্যা May 01, 2024
img
সারাক্ষণ এসিতে থাকলে যেসব সমস্যায় ভুগতে পারেন May 01, 2024
img
বিলাসিতা ছেড়ে শ্রমিকদের কল্যাণে নজর দিন, শিল্প মালিকদের প্রধানমন্ত্রী May 01, 2024
img
আজও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে May 01, 2024
img
আমরা চিকিৎসক সুরক্ষা আইন পাস করাব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী May 01, 2024
img
সংসদ অধিবেশন শুরু হচ্ছে কাল May 01, 2024
img
শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক রেখে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর May 01, 2024
img
ছয় অলরাউন্ডার নিয়ে বিশ্বকাপ দল ঘোষণা আফগানিস্তানের May 01, 2024
img
টানা তাপপ্রবাহ: অবশেষে ঢাকাসহ ৪ বিভাগে বৃষ্টির আভাস May 01, 2024
img
যতবার সরকারে এসেছি ততবার শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়েছি: প্রধানমন্ত্রী May 01, 2024