রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে হরে-দরে সবাইকে ‘শাহবাগী’ বলা বন্ধ করতে হবে: মাহফুজ

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে হরেদরে সবাইকে ‘শাহবাগী’ বলা বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। বুধবার দীর্ঘ এক ফেসবুক পোস্টে এ আহ্বান জানান।

দীর্ঘ পোস্টের শুরুতে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিল। কিন্তু নাহিদ ইসলাম যেভাবে বলেছেন এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁরা কাফফারা দিয়েছেন। আমিও বলেছি, জামায়াতের যাঁরা বাংলাদেশপন্থী, তাঁরা এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। জামায়াতের নতুন প্রজন্মের অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে কেউই পাকিস্তানপন্থী নন। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ [তকমা] দিয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না। রাজনৈতিক ও আদর্শিক লড়াই করেই তাদের বিরুদ্ধে জিততে হবে। তাদের প্রোপাগান্ডা ওয়ারের [অপপ্রচারমূলক লড়াই] জবাব দিতে হবে সত্য দিয়ে।’

রাজধানীর শাহবাগে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বে আন্দোলন প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘শাহবাগে যারা গিয়েছিল [তাদের] একটা বড় অংশ “চেতনা”র অন্ধতায় পড়ে গিয়েছিল। অনেক ছাত্র-তরুণ ইসলামবিদ্বেষ থেকে না; বরং নিছক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে গিয়ে উপস্থিত ছিল। তরুণ প্রজন্মের আবেগকে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের মুজিববাদী অংশ কাজে লাগিয়ে এ দেশে মবোক্রেসি [মবতন্ত্র] কায়েম করেছিল। যার ফসল ছিল দীর্ঘ এক দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন—বিরোধীদলীয় কর্মীদের গুম, খুন, ধর্ষণ ও নিপীড়ন।’

কিন্তু শাহবাগে অংশ নেওয়া অনেক ছাত্র-তরুণই তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে মুজিববাদী বয়ানের বাইরে যেতে চেয়েছেন উল্লেখ করে মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘গত কয়েক বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা অংশীজন ছিলেন। আহত ও নিহত হয়েছেন। তাঁরা আমাদের সহযোদ্ধা। তাঁরা আমাদের কমরেডস বটে! এ অভ্যুত্থানে শক্তিশালী ভূমিকা রেখে তাঁরা লীগ ও মুজিববাদের পরাজয় নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে তাঁদের রাজনৈতিক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত, তথা কাফফারা আদায় করেছেন।’

২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে টেনে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘আমি নিজে শাপলায় এসেছিলাম লংমার্চে নবীজির প্রতি ভালোবাসায়। ৫ মে-তে আমি আসতে পারিনি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামায়াত নেতাদের ভূমিকা নিয়ে আমাদের আগ্রহ ছিল না। আমরা মূলত নবীজির সম্মান ও ভালোবাসা সামনে রেখে ঢাকায় এসেছিলাম। আমি শর্ষিণাপন্থী যে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ইসলাম বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।’

মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না, অধিকাংশ শাপলার কর্মীরাই আসলে জামায়াতের আকিদা (বিশ্বাস ও কর্মপন্থা) ও নেতৃত্ববিরোধী। শাপলার অনেক নেতৃত্বই জামায়াতের আলেম ও পীরপন্থা বিরোধিতার শিকার। এমনকি অনেকেই জামায়াত ও শিবির নেতাদের কর্তৃক নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়েছেন। কিন্তু জামায়াত সফলভাবেই তাদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছে। যেমন লীগ “শাহবাগী”দের ব্যবহার করেছে।’

তিনি লিখেছেন, ‘আমরা অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে উপনীত হয়েছি। এখানে জামায়াতকে বা শিবিরের কর্মীদের “রাজাকার”, “স্বাধীনতাবিরোধী” বলে বধযোগ্য করার যে বয়ান সেটার বিরোধী আমরা। তেমনি শাহবাগের ইসলামফোবিয়ার [ইসলামবিদ্বেষ] বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান। এ ইসলামফোবিয়ার শিকার আমি নিজে হয়েছি। পাঞ্জাবি–টুপি পরলেই জঙ্গিবাদী বলা থেকে শুরু করে মাদ্রাসাছাত্রদের ও আলেমদের বিমানবিকীকরণের জন্য শাহবাগ দায়ী। শাহবাগের সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের ঊনমানুষে পরিণত করেছিল।’

শাপলা-শাহবাগের কর্মীরা কমরেডস হয়েছিলেন বলেই শেখ হাসিনার পতন ঘটেছিল উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে একটি সংলাপমুখর সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। শাপলা- শাহবাগের বাইনারির বাইরে এসে শাহবাগের প্রাণভোমরা—মুজিববাদ, ভারতপন্থা ও শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে পুরাতন শাপলা ও শাহবাগের কর্মীদের “কমরেডস” হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। আসলে শাপলা-শাহবাগের কর্মীরা কমরেডস হয়েছিলেন বলেই শেখ হাসিনার পতন ঘটেছিল। এদিকে শাপলার নেতৃত্বের জন্যও কারও প্রক্সি না হয়ে রাষ্ট্রে ইজ্জত ও শরিকানা দাবির সুন্দর সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল।’

চরমপন্থী কোনো গোষ্ঠীর হাতে তৌহিদি জনতার নেতৃত্ব ছেড়ে না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন মাহফুজ আলম। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘আমি আমার আগের দুটি পোস্টে আলেম-ওলামাদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম, তাঁদের শক্তিশালী ভূমিকার জন্য।

তৌহিদবাদী জনতার নেতৃত্ব যেন ফ্রিঞ্জ এলিমেন্টের (চরমপন্থী গোষ্ঠী) হাতে না গিয়ে মূলধারার হকপন্থী আলেমদের হাতে থাকে, এ আশা রাখি। মূলধারার আলেমরা আশা করি গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে, দেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে শাহবাগের মবোক্রেসি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। নিজেরা সে সংস্কৃতির অনুকরণ করবেন না। এ ক্ষেত্রে আমরা মজলুম ও গণতান্ত্রিক মূলধারার আলেমদের পক্ষেই থাকব।’

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শাপলার গণহত্যার বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা শাপলার হত্যাযজ্ঞ ডকুমেন্টেশনের [নথিপত্র সংগ্রহের] কথা বলেছেন। আশা করি, শাপলায় শহীদ মাদ্রাসাছাত্র ও আলেমদের বিরুদ্ধে যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বর্বর শেখ হাসিনা, তার সুষ্ঠু তদন্ত, ডকুমেন্টেশন ও বিচার নিশ্চিত হবে।’

গণজাগরণ মঞ্চ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার পটভূমি তৈরি না করতে আহ্বান জানিয়ে মাহফুজ আলম লিখেছেন, ‘সাবেক “শাহবাগী” যাঁরা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিজেদের ন্যায্য অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, লড়াই করেছেন, তাঁদের কোনোভাবেই বধযোগ্য করে তোলা যাবে না। যাকে তাকে “শাহবাগী” ট্যাগ দিয়ে অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে বৃহত্তর সংহতির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা যাবে না। শাপলাপন্থী কেউ যদি ভাবেন, লীগবিরোধী ও অভ্যুত্থানের পক্ষের সাবেক “শাহবাগী”দের শত্রু ও বধযোগ্য বানিয়ে তাঁরা সফল হবেন, তা কিন্তু হবে না। আপনি শাপলার হয়ে মবোক্রেসি ও বিচারহীনতার দাবি করলে আপনিও তো “শাহবাগী” হয়ে উঠবেন, নাকি? বামপন্থীদের মধ্যে যাঁরা মুজিববাদবিরোধী, তাঁরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই শাপলার হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ফলে,শত্রু-মিত্র ফারাক করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।’

মাহফুজ আলম আরও লিখেছেন, ‘তবে পুরোনো “শাহবাগী”, যারা এখনো শাহবাগের প্রাণভোমরা—মুজিববাদ, ভারতপন্থা ও শেখ পরিবারের প্রতি আনুগত্যকে নিজেদের আদর্শ বলে মনে করে, তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। এরাই গুম ও গণহত্যার উসকানি দিয়েছিল ও ন্যায্যতা তৈরি করেছিল। জুলাই গণহত্যার সময়ও এরা চুপ ছিল, কেউ কেউ বৈধতা উৎপাদনে ব্যস্ত ছিল। বিদেশ থেকে এখনো যারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে সাফাই গাইছে, এদের একটা বড় অংশ শাহবাগের ফ্যাসিবাদী। এরা জনগণের শত্রু, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের শত্রু, গণ-অভ্যুত্থানের শত্রু। এদের বিচার শুরু হয়েছে, শেষও হবে।’

পোস্টের শেষ অংশে দেশে চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন মাহফুজ আলম। তিনি লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে শাহবাগে বেড়ে ওঠা মবোক্রেসি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি সব পক্ষকেই বাদ দিতে হবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সহনাগরিকদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ সংলাপ ও সংহতির দিকে সবাইকে এগোতে হবে। শাহবাগের ছাত্র-তরুণ যাঁরা মুজিববাদের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, “শাহবাগী” ট্যাগ দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মব উসকে দেওয়া বা বিভেদ তৈরি সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রাজনৈতিক ভেন্ডাটা [প্রতিহিংসা] থেকে হরে-দরে সবাইকে শাহবাগী বলা বন্ধ করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই থাকবেই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও মৈত্রী বাড়াতে হবে, শত্রু কমাতে হবে এবং চিহ্নিত শত্রুর দীর্ঘ মেয়াদে পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে।’

আরএইচ/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
১৮ জুলাই মুক্তি পাচ্ছে সোনাক্ষীর রহস্য থ্রিলার 'নিকিতা রায়' Jul 01, 2025
img
আসছে 'আপনে ২', একসঙ্গে দেখা যাবে দেওল পরিবারের তিন প্রজন্মকে Jul 01, 2025
img
ঠিক হল চিরঞ্জীবীর বিশ্বম্ভরার নতুন মুক্তির দিন Jul 01, 2025
img
ফ্যামিলি ছবি নয়, এবার প্রাপ্তবয়স্ক থ্রিলার থাম্মুদু Jul 01, 2025
img
শুধু প্রেম নয়, বলিউডে টিকে থাকতে প্রমাণ দরকার Jul 01, 2025
img
‘সরদার জি ৩’ বিতর্কে মুখ খুললেন ইমতিয়াজ Jul 01, 2025
img
গাজায় সমুদ্রতীরবর্তী ক্যাফেতে ইসরায়েলি হামলায় ২০ জনের মৃত্যু Jul 01, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টা-রুবিও ফোনালাপে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা Jul 01, 2025
img
জুলাই নিয়ে ফেসবুকে ফারুকীর আবেগঘন স্ট্যাটাস Jul 01, 2025
img
মামলা তুলবেন না মুরাদনগরের সেই নারী Jul 01, 2025
img
হাসপাতালে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, কী হল পরিচালকের? Jul 01, 2025
img
পাক-বিতর্কে দিলজিতের পাশে নাসিরুদ্দিন শাহ Jul 01, 2025
img
ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত চীন Jul 01, 2025
img
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শুরু Jul 01, 2025
img
গণসংহতির কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ Jul 01, 2025
img
আগস্টে ঢাকায় আসছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি Jul 01, 2025
img
গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি ছাত্রদলের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন Jul 01, 2025
img
শাহজালাল বিমানবন্দরে ভিআইপিদের লাগেজে কড়া নজরদারির নির্দেশ Jul 01, 2025
img
একটি গোষ্ঠী ছাত্র সংসদ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে : জাহিদুল ইসলাম Jul 01, 2025
img
৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন Jul 01, 2025