গাজীপুরে টোকেন নিয়ে কিনতে হচ্ছে ঘোড়ার মাংস

গাজীপুরে বেশ কিছুদিন ধরে ঘোড়া জবাই করে মাংস বিক্রিকে কেন্দ্র করে নগরজুড়ে ব্যাপক কৌতূহল ও আলোচনার ঝড় বইছে। ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল না হারাম তা নিয়ে চলছে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা। কিছু অসাধু লোক ঘোড়ার মাংস কমদামে কিনে তা গরুর মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

তবে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলছেন, ঘোড়ার মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ নয়। তবে এ ব্যবসা করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। তুলনামূলক কম দাম ও স্বাদের কারণে ক্রেতাদের মধ্যে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

ইসলাম ধর্মে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বলেও জানিয়েছেন মুফতি ও ইসলামি চিন্তাবিদরা। তবে এ মাংস খাওয়া নাজায়েজ বলেও কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ মত দিয়েছেন। আর স্বাস্থ্যগত কিছু বিষয় নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে চিকিৎসকদের।

গাজীপুরে ২০২৫ সালের শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে ঘোড়ার মাংস বিক্রি শুরু হয়। বর্তমানে প্রতি শুক্রবার প্রায় ৪০০ কেজি ঘোড়ার মাংস বিক্রি হচ্ছে। প্রথমদিকে কেবল একটি ঘোড়া জবাই করা হলেও এখন প্রতি সপ্তাহে ৬-৭টি ঘোড়া জবাই করে বিক্রি করা হচ্ছে।

মূলত মাংসের দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা এতে আগ্রহী হচ্ছেন। যেখানে গরুর মাংসের বাজারদর প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা, সেখানে ঘোড়ার মাংস মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও ঘোড়ার মাংস খাওয়ার দিকে ঝুঁকছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুজ্জামান বলেন, এলাকার মানুষ প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও এখন অনেকে খাচ্ছে।

ঘোড়ার মাংস বিক্রি শুরু করা দুই বন্ধু শফিকুল ইসলাম ও নুরুল্লাহ মামুন জানান, দুবাই ভ্রমণের সময় তারা দেখেন, সেখানে রেস্টুরেন্টে ঘোড়ার মাংস জনপ্রিয়। দেশে এটি প্রচলিত না থাকলেও কম দামে বিক্রি করা গেলে মানুষ গ্রহণ করবে, এই ধারণা থেকেই তারা এই ব্যবসায় নেমেছেন।
শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে মানুষ একটু সন্দেহ করত। কিন্তু আমরা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধতা এবং স্বাদের বিষয়ে নিশ্চিত করায় এখন অনেকেই কিনছে।

শাইখুল হাদিস আল্লামা মুফতি আব্দুল কাইয়ুম মিরাজী বলেন, পৃথিবীর কোনো মাওলানা ঘোড়ার মাংস খাওয়াকে হারাম বলতে পারবেন না। এটি হালাল এবং ইসলামসম্মত।

তবে শায়খ আহমাদুল্লাহ ইউটিউবে প্রচারিত এক প্রশ্নের জবাবে ঘোড়ার মাংস খাওয়াকে নাজায়েজ বলে মত দিয়েছেন।

এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোড়ার মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।

টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট ডাক্তার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঘোড়া সাধারণত মালামাল পরিবহন ও দৌড়ানোর জন্য ব্যবহার হয়। তাই তাদের খাবারে কখনো কখনো কিছু কেমিক্যাল মেশানো হয়, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে যদি ঘোড়াকে স্বাভাবিক খাবার যেমন ঘাস ও প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে লালন-পালন করা হয়, তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই।
গাজীপুরে ঘোড়ার মাংস বিক্রির এই উদ্যোগ এখনো বেশ নতুন। কেউ একে স্বাগত জানাচ্ছেন, কেউ আবার দ্বিধায় রয়েছেন। তবে ক্রেতাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা ইঙ্গিত দেয় ভবিষ্যতে এটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

তবে মাংসের মান ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় প্রশাসনেরও বিষয়টি নজরে রাখা উচিত, যাতে কোনো রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াই মানুষ নতুন এই মাংস গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া যে ঘোড়া তারা কিনে এনে বিক্রি করেছেন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হচ্ছে না।

জানা গেছে, গাজীপুরে দুই বন্ধুর উদ্যোগে ঘোড়ার মাংস বিক্রির প্রচলন করার পর প্রতি শুক্রবার অসংখ্য ক্রেতা মাংস কিনতে এলাকায় ভিড় জমান। গাজীপুর মহানগরীর হায়দরাবাদ এলাকার আত্-তাকওয়া মসজিদ ও মাদরাসা সংলগ্ন পুকুর পাড়ে বাউন্ডারি বেষ্টিত নির্ধারিত স্থানে এলাকার ক্রেতা ছাড়াও আহলে হাদিস অনুসারী লোকজনসহ দূর-দূরান্তের অনেক ক্রেতাকে ঘোড়ার মাংস কেনার হিড়িক পড়তে দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত কম দামে অপ্রচলিত অথচ গরুর মাংসের মতো সুস্বাদু ঘোড়ার মাংস বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়ে।

ঘোড়ার মাংস বিক্রেতা দুই বন্ধু আ.ন.ম নুরুল্লাহ মামুন ও শফিকুল ইসলাম জানান, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন স্থান থেকে পিকআপ যোগে ১৫-১৬টি ঘোড়া কিনে আনা হয়। ওইদিন রাত থেকে শুক্রবার জুমার নামাযের পূর্ব পর্যন্ত মোট ১১টি ঘোড়া জবাই করা হয়। কিন্তু ধারণার বাইরে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে গেলে অগ্রিম তালিকাভুক্ত করে সিরিয়াল অনুযায়ী মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে। অধিক সংখ্যক ক্রেতা থাকায় জনপ্রতি সর্বাধিক ৩ কেজি মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে ১ হাজার টাকায়। কিন্তু কাউকে ১ কেজি, ২ কেজি এবং ৩ কেজির বেশি মাংস দেওয়া হয় না।

তারা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষি ও পণ্য পরিবহন কাজে ব্যবহৃত অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও দুর্বল প্রকৃতির নানা সাইজের ঘোড়া জবাই করে কম-বেশি ৭০-৮০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। ঘোড়ার মাংসে চর্বি কম, গরুর মাংসের মতো স্বাদ ও পাশাপাশি দামও অপেক্ষাকৃত কম থাকায় এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে বলে জানান তারা।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহিন মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আইনে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ নয়। তবে জবাই করে কোনো মাংস বিক্রি করতে হলে প্রাণিসম্পদ বিভাগের লাইসেন্স লাগে। এলাকায় ঘোড়ার মাংস বিক্রির কোনো লাইসেন্স নেই। এ ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট করতে হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।


এমআর/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মৌলিক সংস্কার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না : গোলাম পরওয়ার Aug 28, 2025
img
লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা Aug 28, 2025
img
স্বর্ণজয়ী ফাতেমা মুজিব ছাড়াই শুরু হচ্ছে ফেন্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ Aug 28, 2025
কালো-সোনালি পোশাকে জয়া, ঝলকে উঠল সৌন্দর্য! Aug 28, 2025
সুরা ফাতেহা নতুনভাবে আবিষ্কার Aug 28, 2025
img
জাতীয় দলের প্রস্তুতিতে যোগ দিতে আরব আমিরাতে রশিদ Aug 28, 2025
img

জিল্লুর রহমান

সম্পর্ক পুনর্গঠন চাইলে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতেই হবে Aug 28, 2025
img
যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিলো রাশিয়া Aug 28, 2025
img
মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে কেউ পার পাবে না : প্রিন্স Aug 28, 2025
img
দেশের জন্য সবকিছু ছেড়ে এসেছি : বিসিবি সভাপতি Aug 28, 2025
img
বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমছে সাড়ে ৫ বছর Aug 28, 2025
img
১০ সংস্কার কমিশনের ৪৮ সুপারিশ বাস্তবায়িত : প্রেসসচিব Aug 28, 2025
img
গফরগাঁওয়ে নদীতে মাছ ধরতে নেমে প্রাণ গেল তরুণের ‎ Aug 28, 2025
img
বিচ্ছেদ জল্পনা তুঙ্গে উঠতেই বড় ইঙ্গিত যশরত জুটির Aug 28, 2025
img
গুমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! Aug 28, 2025
img
ইরানের নির্ভরযোগ্য অংশীদার চীন: পেজেশকিয়ান Aug 28, 2025
img
১৮ মাসে ১ কোটি চাকরি সৃষ্টিতে বিএনপির প্রস্তুতি রয়েছে : আমীর খসরু Aug 28, 2025
img
এক বছরের মধ্যে পাকিস্তানের ক্রিকেট বদলে দেওয়ার আশ্বাস পিসিবি চেয়ারম্যান নাকভির Aug 28, 2025
img
রমনার ডিসি মাসুদের সেই ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি : ডিএমপি Aug 28, 2025
img
উপসচিব পদে পদোন্নতি আরও ২৬৮ কর্মকর্তার Aug 28, 2025