ছোট হয়ে আসছে দেশের শ্রমবাজার, রপ্তানি কমেছে ৩০ শতাংশ

গত এক বছরে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জনবল রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের শ্রমবাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে চলেছে।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ কর্মী গিয়েছেন মাত্র পাঁচটি দেশে—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

তবে এই সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম। সে বছর ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ জন কর্মী বিদেশ পাঠানো হয়।২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৯৭ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী বিদেশে যান। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৪৪২ জনে। অর্থাৎ চলতি বছর জানুয়ারির তুলনায় কেবল ফেব্রুয়ারিতেই জনবল রপ্তানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

তিনটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এগুলো হলো— মালয়েশিয়া, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশগুলোতে নিয়োগ কমে যাওয়ায় এবং মালয়েশিয়া, ওমানের পাশাপাশি বাহরাইনের শ্রমবাজারও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

এর মাঝে অবশ্য সরকার নতুন শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করছে, তবে তাদের সাফল্যকে এখনো পর্যাপ্ত বলা যায় না। বিদ্যমান বাজারগুলো চালু করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নতুন সরকারে শ্রমবাজারের অবস্থা
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর জনশক্তি ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু নতুন সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা প্রবাসী কল্যাণ নিয়ে নানা সময়ে বক্তব্য দিলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

প্রধান শ্রমবাজারগুলোর অবস্থা মালয়েশিয়া
২০২৩ সালে সাড়ে তিন লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন থেকে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৪ সালে এক লাখেরও কম কর্মী দেশটিতে যেতে পেরেছেন।

ওমান
২০২৩ সালে ওমানে সোয়া লাখের বেশি কর্মী যান, কিন্তু ২০২৪ সালে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় মাত্র ৩৫৮ জন কর্মী যেতে পেরেছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত
২০২৩ সালে প্রায় এক লাখ কর্মী আমিরাতে গিয়েছিলেন। তবে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজারে।

বাহরাইন
২০১৭ সাল থেকে বাহরাইনে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। গত বছরও দেশটি বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীও নেয়নি।

দক্ষ কর্মীর অভাব ও বিকল্প শ্রমবাজার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানোর হার একেবারেই কম। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান প্রতিশ্রুতিশীল শ্রমবাজার হলেও ভাষা ও পেশাগত দক্ষতার অভাবে অনেকেই সেখানে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছেন না।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। অথচ সে বছর মাত্র ৪ হাজার ৪৯৬ জন কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়। ২০২৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে গিয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৯১৮ জন।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকার দাবি করে বাংলাদেশ থেকে ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে ৯৫ শতাংশ কর্মীই যাচ্ছে মাত্র ছয়টি দেশে। বাকি দেশে নামমাত্র কর্মী পাঠানো হচ্ছে, কোথাও তা মাত্র ২ থেকে ৩/৪ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে বাংলাদেশি ও মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণে। অনেক কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ পাননি। ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। সরকারকে দ্রুত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবকাঠামো খাত বন্ধ থাকায় কর্মী নিয়োগ কমে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে গত বছর ৬ লাখ কর্মী যাওয়ায় (এ বছর) চাহিদা কমে গেছে বলে জানান এই গবেষক।

দেশের ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী বলেন, ‘শ্রমবাজারের সংকট কাটাতে হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজারগুলো দ্রুত খুলতে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যায় পরামর্শ দিয়ে হায়দার আলী বলেন, ‘বিকল্প বাজার তৈরি না করা গেলে (দেশের) শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়বে। তখন মানুষ অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করবে, যা আরও বিপজ্জনক হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংকুচিত হয়ে যাওয়া কাতার ও সৌদির শ্রমবাজারে লোক পাঠানো আরও বাড়াতে হবে। থাইল্যান্ড সম্ভাবনাময় একটি বাজার ছিল, সেটিও বন্ধ। এটি চালু করতে দুই দেশের আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সাত-আটটি বড় শ্রমবাজারের মধ্যে তিনটি বন্ধ রয়েছে। কাতার, কুয়েত ও সৌদি আরবেও কর্মী নিয়োগ কমেছে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান গত এক বছর ধরে শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে। এসব বাজার খুলতে না পারলে কর্মী পাঠানোর হার আরও কমে যাবে।’

কী বলছে সরকার
বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হাই বলেন, ‘আমরা শ্রমবাজার বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি; নতুন নতুন বাজার খুলছি। যেমন : রাশিয়া, পর্তুগাল, মাল্টা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার কঙ্গোতে নতুন করে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রাশিয়ায় বেশি কর্মী যাচ্ছে।’

ইরাক ও ইরানেও কর্মী পাঠানো হচ্ছে জানিয়ে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ইরাকে ৫০০ ডলার বেতনে ৫০ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

ইউরোপের শ্রমবাজার নিয়ে আব্দুল হাই বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় সব ইউরোপীয় দেশের দূতাবাস থাকলেও কর্ম ভিসার জন্য ভারত বা নেপালের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়, যা বাংলাদেশিদের ইউরোপে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।’

এমআর


Share this news on:

সর্বশেষ

img
জেলে থাকা ৮০ শতাংশ মানুষ নির্দোষ : রিয়া চক্রবর্তী Mar 26, 2025
৭১-২৪ প্রসঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপি ও এনসিপি Mar 26, 2025
img
হবিগঞ্জে পিক-আপের সাথে সিএনজির সংঘর্ষে নিহত ২ Mar 26, 2025
img
রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড, ২৪ দিনেই আসলো ২৭৫ কোটি ডলার Mar 26, 2025
দ্বি-জাতিতত্ত্ব নিয়ে যা বললেন ধর্ম উপদেষ্টা Mar 26, 2025
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে 'হতাশ' হয়েছেন মির্জা ফখরুল Mar 26, 2025
৭১ এবং ২৪ প্রশ্নে কি বললেন নাহিদ? Mar 26, 2025
img
অসহায় গিয়াস উদ্দিনের পরিবারের পাশে তারেক রহমান Mar 26, 2025
মুক্তিযোদ্ধা ও জুলাই যোদ্ধাদের তুলনা করে বক্তব্য রাখায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদ Mar 26, 2025
img
আ.লীগের সাবেক মন্ত্রীর নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দিলেন জেলা প্রশাসক Mar 26, 2025