বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাবেক সভাপতি ও দলটির পরিচিত মুখ দিলীপ ঘোষ শুক্রবার সন্ধ্যায় বিয়ে করেছেন দলীয় সহকর্মী রিঙ্কু মজুমদারকে।
দিলীপের বিয়ের খবর সামনে আসার পর থেকে দুদিন ধরে আলোচনা চলছে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে । এর একটা কারণ দিলীপ ৬১ বছর বয়সে বিয়ে করলেন। অন্য কারণটি হলো হিন্দু পুণরুত্থানবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বা আরএসএসের 'প্রচারক' হিসাবে কাজ করা দিলীপ বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন!
দ্বিতীয় কারণটি নিয়েই আলোচনা চলছে, যেহেতু আরএসএসের প্রচারক থাকাকালীন বিয়ে করার নিয়ম নেই। তবে দিলীপ ঘোষ ১৯৮৪ সাল থেকে আরএসএসের প্রচারক থাকলেও তাকে যখন বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি হিসাবে পাঠিয়েছে সঙ্ঘ, তখন থেকেই তিনি আর 'প্রচারক' নন।
“প্রচারকরা বিয়ে করতে পারবেন না, এটাই সঙ্ঘের নিয়ম। সেই গুরুজী গোলওয়ালকরের আমল থেকেইএ নিয়ম চলে আসছে,” বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের নেতা ড. জিষ্ণু বসু।
তার কথায়, “দিলীপদার বিয়ে নিয়ে সঙ্ঘের কেউ বিস্মিত হয় নি। সংবাদমাধ্যমেই বেশি আলোচনা দেখছি। যেসব গণমাধ্যম বছরে একবারও সঙ্ঘের খবর ছাপে না, তারাই দেখছি দিলীপদার বিয়ে নিয়ে সবথেকে বেশি উৎসাহিত। বিয়ে কেন্দ্রিক সঙ্ঘের নানা নিয়ম নিয়ে লেখা হচ্ছে!”
বিজেপি ও আরএসএস ঘনিষ্ঠ বিজেপির একাধিক নেতা বলেছেন, দিলীপ ঘোষের অশীতিপর মায়ের অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা যে তার রাজনীতিবিদ পুত্র বিয়ে করে সংসারী হন।
“বছর চারেক ধরেই দিলীপ দার মা ছেলেকে বিয়ের কথা বলছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যে তিনি ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজও করেছিলেন। তখনই দিলীপদার সঙ্গে রাজনীতির ময়দানেই রিঙ্কু মজুমদারের আলাপ পরিচয় এবং তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দিলীপদার বিয়ের ব্যাপারটা আমরা জানতে পারি চার-পাঁচদিন আগে। দলের কেউই কিন্তু বিস্মিত হন নি বিষয়টাতে," বলছিলেন দিলীপ-ঘনিষ্ঠ এক নেতা।
শুক্রবার কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউনে অতি ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের উপস্থিতিতে আইনি এবং বৈদিক মতে তাদের বিবাহ হয় বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।
দিলীপ ঘোষের বাসভবনে গিয়েছিলেন সুকান্ত মজুমদারসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। সেখানে সুকান্ত বলেন, “বহু রাজনৈতিক নেতাই অনেক বেশী বয়সে বিয়ে করেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিও তো অনেক বয়সে বিয়ে করেছিলেন। সিপিআই নেতা ইন্দ্রজিত গুপ্তরও অনেক বয়সে বিয়ে হয়। আসলে রাজনীতি করতে এসে বা সামাজিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ফলে বিয়ে করার সময়টাই হয় ওঠে না অনেকের।”
তারা দলের তরফ থেকে দিলীপ ঘোষ এবং তার নববধূকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছেন।
আরএসএসের নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রচারককে সম্পূর্ণ সময়টাই সংগঠনের কাজে দিতে হয়। পরিবার প্রতিপালনের জন্য যদি সময় বের করতে হয়, তাহলে সংগঠনকে পুরো সময় দেওয়া সম্ভব নয় বলেই প্রচারকদের বিয়ে করার নিয়ম নেই।
ড. জিষ্ণু বসু বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “একজন প্রচারককে পুরো সময়টাই সঙ্ঘের কাজে দিতে হয়। তাই আলাদা করে পরিবারকে দেওয়ার মতো সময় প্রচারকের থাকে না। সেজন্যই দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজী মাধব গোলওয়ালকরের সময় থেকেই প্রচারকদের বিয়ে না করার নিয়ম রয়েছে।”
“আবার সঙ্ঘের মাসিক অর্থায়নেই তার দৈনন্দিন খরচ চলে। তাই কোনও প্রচারককে যখন রাজনীতি করতে পাঠানো হচ্ছে, তখন তো তিনি আর সঙ্ঘের কাজ করছেন না, তার দৈনন্দিন খরচও সেই রাজনৈতিক দলকেই দিতে হবে। তাই প্রচারকও আর তিনি থাকতে পারবেন না,” ব্যাখ্যা করছিলেন ড. বসু।
এই নিয়ম অনুযায়ীই দিলীপ ঘোষকে যখন বিজেপির সভাপতি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হয় ২০১৫ সালে, তখন থেকেই তিনি আর সঙ্ঘের প্রচারক নন।
তার পরে তিনি ২০১৬ সাল থেকে বিধানসভার সদস্য ও ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন, সেখান থেকে ভাতা পেতেন তিনি। অন্য কোনওভাবে অর্থের সংস্থান তৈরি হলে প্রচারক থাকা যায় না।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার যোগ করলেন, “সঙ্ঘ থেকে যাদের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক করে পাঠানো হয়, তারা আর প্রচারক থাকতে পারেন না। তবে বিজেপির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে যারা আসেন, তাদের অতীতে কোনো না কোনো সময় প্রচারকের ভূমিকায় থাকতে হয়।”
বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী, প্রথম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে অন্যতম লাল কৃষ্ণ আদভানি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিনজনই আরএসএসের প্রচারক ছিলেন।
বাজপেয়ী বিয়ে করেননি। মোদি প্রচারক হওয়ার আগে বিয়ে করেছিলেন, তবে প্রচারক হওয়ার পর সংসারজীবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আদভানিও প্রচারক ছিলেন, তবে বিয়ের আগে প্রচারকের পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
“লাল কৃষ্ণ আদভানি সংসার জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি প্রচারকের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এরকম বহু উদাহরণ আছে যারা সঙ্ঘের প্রচারক থেকে সংসারী জীবনে ফিরে গেছেন," জানাচ্ছিলেন ড. জিষ্ণু বসু।
তার কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে হয়তো সংখ্যাটা কম, কিন্তু মহারাষ্ট্র বা ওড়িশার মতো রাজ্যে এরকম উদাহরণ কয়েকশো। তারা একটা সময়ে প্রচারক হিসাবে সঙ্ঘে থেকেছেন, তারপরে মনে হয়েছে সংসার করবেন, তাই তারা প্রচারকের দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন।”
সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতা বলছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেনেন, এমন অন্তত দুজন সঙ্ঘ-প্রচারকের কথা বলতে পারি যারা পরবর্তীতে সংসারী হয়েছেন। একজন কৈলাশ বিজয়বর্গীয় আরেকজন অরবিন্দ মেনন।”
আরএসএস প্রধানের আনুষ্ঠানিক পদ-নাম হল সর-সঙ্ঘচালক। প্রতিষ্ঠাতা সর-সঙ্ঘচালক কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বা দ্বিতীয় সর-সঙ্ঘচালক মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর থেকে শুরু করে বর্তমান সর-সঙ্ঘচালক মোহন ভগবত – কেউই বিয়ে করেন নি।
সর-সঙ্ঘচালকরা প্রচারক পদ থেকেই উঠে আসেন। তবে একটা সময় ছিল যখন প্রচারকরাও বিয়ে করতে পারতেন।
ড. জিষ্ণু বসু বলছিলেন, “এখনকার সর-সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের বাবা মধুকর রাও ভাগবত সঙ্ঘের একেবারে আদিযুগের প্রচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি তো বিবাহিত ছিলেন। দ্বিতীয় সর-সঙ্ঘচালক গোলওয়ালকরের সময় থেকে এই নিয়ম চালু হয়।”
“আসলে গোলওয়ালকর তো রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের ভক্ত ছিলেন। সেখানকার সাংগঠনিক নিয়মকানুনই তিনি সঙ্ঘে চালু করেন। রামকৃষ্ণ মিশনে যেমন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্যে দিয়ে একজন সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন, আমাদের সঙ্ঘেও তাই নিয়ম। প্রথম পর্যায়ে বিস্তারক হয়ে যোগ দেওয়া, তারপরে দুই বা তিন বছরের কড়া ট্রেনিং কোর্সের শেষে প্রচারক হওয়া যায়,” জানাচ্ছিলেন ড. জিষ্ণু বসু।
বিবাহ বা সংসারের ব্যাপারে নিয়মগুলো কিন্তু শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রেই, কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে কোনও নারী সদস্য নেই। নারীদের জন্য রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি নামে সমান্তরাল একটি সংগঠন আছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএন