সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম বলেছেন, নতুন রাষ্ট্র ও রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল।
শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে রাজধানী গুলিস্তানের শহীদ আবরার ফাহাদ এভিনিউতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুব সংগঠন ‘জাতীয় যুবশক্তি’ আত্মপ্রকাশ করে।
অনুষ্ঠানে ১৩১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক হিসেবে অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম, সদস্য সচিব ডা. জাহেদুল ইসলাম ও মুখ্য সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ সোহেলের নাম ঘোষণা করা হয়।
পরে জাতীয় যুবশক্তির ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সংগঠনটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম। ঘোষণাপত্রের শুরুতে তিনি জুলাইয়ের সব শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, জাতীয় যুবশক্তি বিশ্বাস করে, ইতিহাসের প্রতিটি মৌলিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণরা এবং এখন সময় এসেছে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও নতুন প্রজাতন্ত্র নির্মাণের। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে—যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের উপনিবেশবিরোধী আজাদীর লড়াইয়ে, পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে, আর এক নতুন দিশা ও প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছে ২০২৪-এর ঐতিহাসিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
এই অভ্যুত্থান কেবল ক্ষোভের বিস্ফোরণ নয়—এটি ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক কল্পনার জন্মমুহূর্ত, যেখানে তরুণেরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে বর্তমান ব্যবস্থা আর চলতে পারে না, প্রয়োজন এক নতুন রাষ্ট্রকল্প, এক নতুন পথ। নতুন রাষ্ট্র ও রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল। যুবশক্তি জুলাই গণঅভ্যুত্থানেরই ধারাবাহিকতা।
জাতীয় যুবশক্তি দায় ও দরদের রাজনীতি চায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যেখানে নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব গ্রহণ, সহানুভূতিশীলতা, সহনশীলতা এবং নাগরিকের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ হবে। দায়িত্ব, সহানুভূতি ও মানবিকতা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দায় ও দরদের রাজনীতিই অধিকার ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করে। তাই দায় ও দরদের অনুশীলন আমাদের রাজনীতির অন্যতম নৈতিক ভিত্তি।
অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে নাগরিক মর্যাদা কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হবে, যেখানে রাষ্ট্র সব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিসত্তার মর্যাদা দেবে, যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবল স্লোগান নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি হবে। যেকোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ ও উগ্রতাকে পরিহার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবোধ ও সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা সম্প্রীতি, ইনসাফ ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক বলেন, বাংলাদেশপন্থা আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার স্বতন্ত্র মেরু—যা বাংলাদেশের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও মানুষের সংগ্রাম থেকে উৎসারিত এক সার্বভৌম রাষ্ট্রচিন্তা। এটি একাধারে ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং আগ্রাসন বিরোধী রাজনৈতিক পথ, কোনো গ্লোবাল শক্তির ছায়ায় নয়, বাংলাদেশের নিজস্ব দিশা, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থে বিশ্বাসী। বাংলাদেশপন্থা মানে হলো এমন একটি কৌশলগত অবস্থান, যেখানে দেশের নীতিনির্ধারণ হবে দেশের ভেতরের বাস্তবতা, জনগণের চাহিদা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ কেবল একটি রাষ্ট্রীয় সীমানা নয়, এটি একটি বদ্বীপীয় সভ্যতা। এই বদ্বীপীয় সভ্যতা আমাদের ভূগোলনির্ভর, বহু ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক এক ঐতিহাসিক সত্তা, যা পাহাড় থেকে নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চলজুড়ে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব নিতে হবে বাংলাদেশকে। সেই নেতৃত্বকে গ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রুপান্তর প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন পথ দেখাবে বাংলাদেশ।
তিনি আরো বলেন, আমরা চাই একটি জাতীয় অর্থনীতি, যা কেবল প্রবৃদ্ধির হিসাব নয়, ইনসাফ ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে; যেখানে কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি হবে সবার নাগালের মধ্যে। রাষ্ট্রে তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। তরুণরা উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবক। দুর্নীতিমুক্ত ও মেধাভিত্তিক একটা রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার জন্য যুবশক্তি কাজ করবে।
অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, আমরা চাই গণতন্ত্র ও সুশাসনের এমন কাঠামো, যা কেবল ভোটেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং প্রতিটি সিদ্ধান্ত, আইন ও নীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হবে, বিচার বিভাগ দলনিরপেক্ষ হবে, স্থানীয় সরকার হবে ক্ষমতাসম্পন্ন, এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সরকার হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক।
তিনি আরও বলেন, এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমাদের প্রধান দাবি—একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও নতুন প্রজাতন্ত্র। আমরা বিশ্বাস করি, সময় এসেছে নতুন সংবিধানের, নতুন রাজনৈতিক চুক্তির, যা এই প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করবে, যা এই প্রজন্মের মর্যাদা ও সুযোগ নিশ্চিত করবে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি, ন্যায্যতা, পরিবেশ ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে এক নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে।
তিনি বলেন, আমরা সেই প্রজন্ম, যারা অতীত জানে, বর্তমান দেখে, এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভয় পায় না। আমরা ৪৭-এর আজাদীর আত্মা বহন করি, ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত, আর ২৪-এর অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারে শপথবদ্ধ। আমরা কেবল উত্তরাধিকার নয়—আমরাই আগামী। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব ও হিস্যা নিশ্চিত করবে যুব শক্তি। আগামীর সংসদ ও আগামীর বাংলাদেশ হবে তরুণদের, নতুনদের।
এ সময় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়কারী নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কারী হান্নান মাসাউদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এসএম/টিএ