কার্ল মার্কস: শ্রমিক শ্রেণির পরম বন্ধু

কার্ল মার্কস। একজন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিকদের একজন। তিনি দূরদর্শী বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ‘মার্কসবাদ’ এর জনক। তার শ্রেণি সংগ্রাম ধারণা ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্ট আদর্শের আবির্ভাব।

১৮১৮ সালের ৫ মে’ জার্মানিতে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কার্ল মার্কস। এক সময় বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে পড়েছেন। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি বিপ্লবীদের নিয়ে গড়া ‘পয়েট’স ক্লাব’ এর সদস্য ছিলেন। পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুন হেগেলিয়ান সংগঠন ‘ডক্টর’স ক্লাব’ এর সদস্য হন।

ছাত্র অবস্থায় কার্ল মার্কস বেশ কিছু গল্প ও কবিতা লিখেছেন, যার অধিকাংশই ছিল বান্ধবী জেনিকে নিয়ে। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ডেমোক্রিটাস ও এপিকিউরাসের বস্তুবাদের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে তিনি ডক্টরাল থিসিস লিখেন। এতে তার বিরুদ্ধে নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে। এ সময় তিনি নিয়মিত রক্ষণশীল প্রুশিয়ান সরকারের সমালোচনা করেন।

এমনকি সমাজতন্ত্রের কথা বললেও যারা বিপ্লবের জন্য বাস্তব সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন না, তাদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি তিনি।
পরে তিনি প্যারিসে চলে যান। এখান থেকে তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান। তার লেখায় সমাজতন্র, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও ধর্মের সমালোচনা ফুটে ওঠে। তিনি ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড ফিলোসোফিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ গ্রন্থে তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।

১৮৪৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দ্য হলি ফ্যামিলি’ বই লিখেন। ১৮৪৫ সালে তাকে ফ্রান্স থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে চলে যান। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। এ দলের ইশতেহার হিসেবে ১৮৪৮ সালে ‘দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টু’ রচনা করেন। এর মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজ পরিবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন মার্কস। তখন ব্রাসেলস থেকেও তাকে বের করে দেয়া হয়।

কার্ল মার্কস প্রথমে প্যারিসে ও পরে লন্ডনে চলে যান। বাকি জীবন তিনি ওখানেই ছিলেন এবং তার লেখালেখি চালিয়ে যান। তিনি কিছুদিন ‘নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ এর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। ওখান থেকেই তিনি আধুনিক সমাজতন্ত্রের ধারণা দিয়ে ঐতিহাসিক ‘দাস ক্যাপিটাল’ বই লিখেন, যাকে সমজতন্ত্রের বাইবেল বলা হয়।

১৮৬৪ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কসম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তার শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বে বলেন, পুঁজিবাদী সমাজে দুটি শ্রেণি, যার একটি বুর্জোয়া বা শাসক শ্রেণি। এরা উৎপাদনের উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যটি হল প্রলিটারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণি যারা মজুরির বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে।

মার্কসের মতে, বুর্জোয়াদের শোষণের ফলে একসময় শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লব করে ক্ষমতায় যাবে এবং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।

তিনি তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বে বলেন, পূর্বের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ন্যায় পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরেও নানা সংকট দেখা দেবে। এর ফলে পুঁজিবাদী সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে যার নাম হবে ‘সমাজতন্ত্র’। তাই পুঁজিবাদী সমাজ উৎখাত করতে শ্রমিকদের সংগঠিত বিপ্লবী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান কার্ল মার্কস।

১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ লন্ডনে বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কসের জীবনাবসান ঘটে। মার্কসের তত্ত্ব ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে তার কর্ম আধুনিক অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। তার কর্মের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক অর্থনীতিতে শ্রম ও পুঁজির মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় ও নতুন অর্থনৈতিক ধারণার বিকাশ হয়েছে।

তাই বিশ্বব্যাপী অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মার্কসবাদী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার দূরদর্শী লেখনী ও চিন্তা পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। তাই তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণির পরম বন্ধু।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
শিক্ষার্থীদের কাছে নূরের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জবি শিবির সেক্রেটারির Nov 02, 2025
img
বিনিয়োগ সম্ভাবনা যাচাইয়ে রাজধানীতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দল Nov 02, 2025
img
আর্সেনালের নির্ভার জয়, হোঁচট খেলো ম্যানইউ Nov 02, 2025
img
যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশকে হারাতে চায় ভারত Nov 02, 2025
img
প্রোটিয়াদের ৪ উইকেটে হারিয়ে সিরিজ জয় পাকিস্তানের Nov 02, 2025
img
রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবে এনসিপি Nov 02, 2025
img
যুবদল নেতা নয়নের চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে গণভোট করা সম্ভব : নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী Nov 02, 2025
img
২০০ যাত্রী নিয়ে ডুবোচরে আটকে গেল লঞ্চ Nov 02, 2025
img
ঢাবি শিক্ষিকাকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে মশাল মিছিল Nov 02, 2025
img
দেশে নতুন প্রতারকের জন্ম হয়েছে : কায়সার কামাল Nov 02, 2025
img
চ্যাম্পিয়ন হলে রোহিত-কোহলিদের সমান বোনাস পাবেন ভারতের মেয়েরা Nov 02, 2025
img
অন্তর্জালে অমির ‘১২ মাস’, নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন অমি Nov 02, 2025
img
‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে বিএনপি সংস্কারবিরোধী অবস্থান নিয়েছে : সাদিক কায়েম Nov 02, 2025
img
কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত : রোকন উদ্দীন Nov 02, 2025
img
নিকোলের সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর স্বীকার করলেন ইয়ামাল, দাবি স্প্যানিশ সাংবাদিকের Nov 01, 2025
img
সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করায় ঐকমত্য কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন Nov 01, 2025
img
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আ. লীগের ঝটিকা মিছিল, গ্রেপ্তার ১৩ Nov 01, 2025
img
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মোতায়েন থাকবে যৌথ বাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য Nov 01, 2025
img
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আ. লীগের প্রভাব ছিল : শামীম হায়দার Nov 01, 2025
img
সকাল ৯টার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের ১১ জেলায় ঝড়ের আভাস Nov 01, 2025