বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের প্রায় সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা সাড়ে চার হাজার বিলিয়ন ডলার। চতুর্থ অর্থনীতির দেশ ভারতের প্রায় ৬২০ বিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের চিরবৈরি পাকিস্তানের বাজেট প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। এই তুলনায় বাংলাদেশের ৬৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট বর্তমান বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আনুমানিক ৫০তম থেকে ৫৫তম স্থানের মধ্যে পড়ে। তবে বাংলাদেশের বাজেট এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের অনেক ধনী দেশের চেয়ে আকারে বড়। এই বাজেটের আকার এখন শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে নয়, বরং অনেক ইউরোপীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।
ইউরোপীয় দেশ হাঙ্গেরির বাজেট বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা ছোট। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটির বাজেট প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। স্লোভাকিয়ার বাজেটের চেয়ে বাংলাদেশের বাজেট প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার বড়। বুলগেরিয়ার চেয়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। এছাড়া লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়ার মোট বাজেটের চেয়ে বাংলাদেশের বাজেট খানিকটা বড়।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু ধনী দেশের চেয়েও বাংলাদেশের বাজেট আকারে বড়। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ধনী কাতারের বাজেটের চেয়ে বাংলাদেশের বাজেট ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি।
বাহরাইনের বাজেটের চেয়ে বাংলাদেশের বাজেট প্রায় ছয় গুণ বড়। ওমানের বাজেটের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বড় বাংলাদেশের বাজেট। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ কুয়েতের বাজেটের চেয়ে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বড় হচ্ছে কৃষি-তৈরি পোশাক শিল্প-প্রবাসী আয়নির্ভর বাংলাদেশের বাজেট। তবে এই দেশগুলোতে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশির চেয়ে অনেক বেশি হলেও, তাদের জনসংখ্যা কম হওয়ায় জাতীয় বাজেটের আকার বাংলাদেশের চেয়ে ছোট।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন মধ্যম আয়ের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়, প্রবাসী আয়ের স্থিতিশীল প্রবাহ এবং শিল্প খাতের সম্প্রসারণ বাজেটকে বড় করার মূল চালিকাশক্তি। জনসংখ্যাভিত্তিক বৃহৎ অর্থনৈতিক কাঠামো এবং উন্নয়ন প্রকল্পের প্রসারও বাজেট আকার বাড়াচ্ছে।
একসময় যেসব ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশকে আর্থিক সক্ষমতার প্রতীক মনে করা হতো, বাংলাদেশের বাজেট আজ অনেক ক্ষেত্রে তাদের অতিক্রম করেছে। এ এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন—যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে নবউত্থানের ইঙ্গিত বহন করে।
৬৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি মাঝারি মাপের কিন্তু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাজেট। বৈদেশিক ঋণ ও ঘাটতি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই বাজেট একটি স্থিতিশীল, রূপান্তরমুখী অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়। সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় নতুন বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ও দেশের ৫৪তম বাজেট এটি। নতুন বাংলাদেশ ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বাজেট দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে বৈশ্বিক আঙ্গিকে একে পর্যালোচনা করতে হলে বাজেটকে ডলারে রূপান্তর করাটা জরুরি।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাজেট ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রকাশ করে নিজস্ব মুদ্রায়। কিন্তু একেক দেশের মুদ্রার মান একেক রকম হওয়ায় তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে সমস্যায় পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে জাতীয় মুদ্রার পাশাপাশি একটি অভিন্ন মুদ্রাতে (যেমন মার্কিন ডলার) বাজেট প্রকাশ করা যায়। ডলার বরাবরের মতোই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত। ডলারে এখনো বিশ্বের দেশগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় প্রকাশ করা হয়। অর্থনৈতিক প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে এই ডলার। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ওইসিডি, ডব্লিউটিও – এসব সংস্থাও বাজেট, ঋণ, জিডিপি, রপ্তানি আয় ইত্যাদি সবকিছুকে ডলারে রূপান্তর করে উপস্থাপন করে।
যেসব আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, বিনিয়োগকারী বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বা অন্য দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা মূল্যায়ন করতে চায়, তারা ডলারের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান চায়। এতে তারা সরাসরি বুঝতে পারে, ঐ বাজেটের আকার কতটা বিশাল বা ক্ষুদ্র।
এক দেশের স্থানীয় মুদ্রা যদি দুর্বল হয় বা অবমূল্যায়িত হয়, তখন ডলারে রূপান্তর করলে প্রকৃত আকার বা ক্ষমতা স্পষ্ট হয়। এটা দেখে বোঝা যায়, দেশে প্রস্তাবিত ব্যয়ের বাস্তব মান কতটা শক্তিশালী।
ডলারে বাজেট রূপান্তর করে, সহজেই বলা যায় বাংলাদেশ বিশ্বের কততম বড় বাজেটধারী দেশ। এই বাজেট ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া বা থাইল্যান্ডের চেয়ে বড়, না ছোট? আমাদের উন্নয়ন বাজেট আফ্রিকার ধনী দেশগুলোর চেয়ে কতটা এগিয়ে। এতে করে অন্যান্য বড় অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গেও তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভবপর হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, সোমবার (২ জুন ২০২৫) মুদ্রার সরকারি বিনিময় হার প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২২ দশমিক ৯৫ টাকা। এই হিসাবে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা সমান ৭.৯ ট্রিলিয়ন টাকাকে ১২২ দশমিক ৯৫ দিয়ে ভাগ করলে হয় ৬৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আন্তর্জাতিক রূপান্তরিত মূল্যমান দাঁড়ায় আনুমানিক ৬৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
এফপি/ টিএ