চাকরির লোভে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে : মানব পাচার চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার

চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করা চক্রের মূলহোতা মুহাম্মদ আলমগীর হোছাইনকে (৪০) গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে গত বুধবার (১২ জুন) ভোরে তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি এর টিএইচবি (মানব পাচার প্রতিরোধ) শাখা।

সিআইডি বলছে, আকর্ষণীয় বেতনে চকলেট কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা বাবুর্চির কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে লোকজনকে রাশিয়ায় নিয়ে যায় একটি চক্র। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করে। ওই যুদ্ধে অংশ নিয়ে কয়েকজন নিহতও হয়েছেন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, গত ৪ ফেব্রুয়ারি বনানী থানায় হওয়া মানব পাচার আইনের মামলায় আলমগীরকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গতকাল তিনি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালত জবানবন্দি নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আলমগীরের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার আমতলী মাঝেরপাড়া গ্রামে।

তিনি বলেন, সিআইডি প্রাথমিকভাবে জানতে পারে, এই চক্রের সদস্যরা রাশিয়ায় মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতনে চকলেট কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা বাবুর্চির কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ১০ জনকে প্রথমে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব পাঠান। সেখানে তাদের ওমরাহ করানোর পর রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে এক সুলতানের কাছে বিক্রি করে দেন।

ওই সুলতান তাদের দাস হিসেবে রাশিয়ার সেনাদের কাছে হস্তান্তর করেন। সেখানে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। যুদ্ধে অংশ নিতে না চাইলে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। খাবার বন্ধ করে দিয়ে তাদের মানসিক শক্তি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন।

সিআইডি জানিয়েছে, যুদ্ধে নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুমায়ুন কবির নিহত এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের আমিনুল নামের একজন গুরুতর আহত হন। রাশিয়ায় পাঠানো ১০ জনের মধ্যে একজন নরসিংদীর পলাশ থানার বাসিন্দা মো. আকরাম হোসেন (২৪) প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যান। পরে তিনি নিজ ব্যবস্থাপনায় গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার কাছে তথ্য পেয়ে যুদ্ধাহত আমিনুলের স্ত্রী ঝুমু আক্তার ঢাকার বনানী থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন।

তদন্তে সিআইডি আরও জানতে পারে, ১০ জনের আরেকটি দল সৌদি আরবে অবস্থান করছে। রাশিয়ায় নিয়ে তাদের জোরপূর্বক যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানাজানি হওয়ায়, তারা রাশিয়ায় যেতে অস্বীকৃতি জানান। এ কারণে সেখান থেকে তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। তাই তারা সৌদি আরবে কোনো কাজ করতে পারছেন না এবং দেশে ফিরতেও পারছেন না।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সিআইডি নেপালে পালিয়ে যাওয়ার সময় মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য ফাবিহা জেরিন ওরফে তামান্নাকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে। ফাবিহা জেরিন ঢাকার বনানীর ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেডের অংশীদার।

সিআইডি ভুক্তভোগীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

অভিযান তদারকির সঙ্গে যুক্ত সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্রেফতার আলমগীর ২০০৮ সালে ছাত্র ভিসায় রাশিয়ায় যান। সেখানে বিয়ে করে তিনি ওই দেশের নাগরিকত্ব পান। এ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ থেকে তিন ক্যাটাগরির ভিসায় ৫০ জনকে রাশিয়ায় নেন। গত এক বছরে ১১ জনকে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় রাশিয়ার সেনা ক্যাম্পে কাজ করার কথা বলে নিয়ে যান। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে তাদের ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করেন। সেখান থেকে পাওয়া টাকাও বিভিন্ন খাতে খরচ হয়েছে ফিরিস্তি দিয়ে আলমগীর কেড়ে নেন।

সিআইডি জানিয়েছে, রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে এ পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছেন। তবে রাশিয়ার সরকার দুজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে তাদের লাশ বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে।

সিআইডি ভুক্তভোগীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। একই সঙ্গে মানব পাচারের এই নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি নিবিড় তদন্ত এবং গ্রেফতার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে।

এফপি/এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলে হামলা চালাবে ইরান Jun 15, 2025
img
দুবাইয়ে ৬৭তলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড Jun 15, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা বাতিল করল ইরান Jun 15, 2025
img
এক ঘণ্টায় ১০ বিমান ভূপাতিত করার দাবি তেহরানের Jun 15, 2025
img
আহত নেতাকর্মীদের খোঁজ নিতে গ্রামের বাড়িতে নুর Jun 15, 2025
img
ইরানের গ্যাসক্ষেত্রে ইসরায়েলের হামলা, নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে আগুন Jun 14, 2025
img
ভালোবাসার ভিন্ন পরিণতি, বলিডডের যেসব থ্রিলার সিনেমায় স্ত্রীরাই হয়ে ওঠেন খলনায়িকা Jun 14, 2025
img
ট্রাম্পকে পুতিনের ফোন, তেহরানে হামলায় নিন্দা প্রকাশ Jun 14, 2025
img
যমুনা সেতুতে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা টোল আদায় Jun 14, 2025
img
ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল Jun 14, 2025
img
শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে ফের মাঠে নামছেন শরিফুল Jun 14, 2025
img
ঈদুল আজহার ১০ দিনের ছুটি শেষে কাল খুলছে অফিস Jun 14, 2025
হেরে যাওয়ার ভয়ে টিম বাংলাদেশ নাম রাখা হয়নি; আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল Jun 14, 2025
১০ মাসের লুকোচুরি শেষে লন্ডনে ধরা দিলেন রেজাউল করিম Jun 14, 2025
"স্বপ্ন দেখেছিলাম শিক্ষক হবো-বাছাই নয়, বেছে বেছে বাদ দেয়া হয়েছে!" Jun 14, 2025
img
২৭ বছর পর আবারো প্রাণরক্ষা, ‘১১এ’ সিটে বসলেই কি জীবন বেঁচে যায়? Jun 14, 2025
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ, ফ্ল্যাট ভোগ করছেন সরকারি আমলারা Jun 14, 2025
img
১০৪ বছরের রেকর্ড ভেঙে ইতিহাস গড়লেন দ. আফ্রিকার মহানায়ক বাভুমা Jun 14, 2025
img
৫ আগস্টের আগে আমি মিছিল করার লোক খুঁজে পাইনি, এখন আমিই জায়গা পাই না: দুলু Jun 14, 2025
img
তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করলেইতো সংস্কার হয়ে যায় : দুলু Jun 14, 2025