মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে বুধবার (১৮ জুন) ওয়াশিংটনে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই উদ্যোগ এমন এক সময়ে এলো, যখন তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং তেহরানের কথিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করার ব্যাপারে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের সূচিতে দেখা গেছে, বুধবার দুপুর ১টায় হোয়াইট হাউসের কেবিনেট কক্ষে “ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের চিফ অব আর্মি স্টাফ” -এর সঙ্গে একটি 'রুদ্ধদ্বার মধ্যাহ্নভোজ' অনুষ্ঠিত হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে কোনো বিদেশি সেনাপ্রধানকে এই ধরনের মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানানো একেবারেই বিরল, প্রায় নজিরবিহীন বলা যায়। ইতিহাসে দেখা গেছে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ যেমন আইয়ুব খান, জিয়াউল হক বা পারভেজ মোশাররফ মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কিন্তু সেটা দেশের ক্ষমতা দখলের পর, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের এই মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ অনেকেই দেখছেন আসিম মুনিরকে পাকিস্তানের 'ডি-ফ্যাক্টো' শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে। একইসঙ্গে ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল যদি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে পাকিস্তান যেন এর বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়— সেই নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্যই এই আলোচনার আয়োজন।
পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই মুহূর্তে তাকে অনেকটাই পশ্চিমা চাপের কাছে নতজানু করে তুলেছে। এর সুযোগ নিয়েই ওয়াশিংটন চাইছে ইসলামি বিশ্বের মধ্যে ইরানকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে।
তবে ট্রাম্পের অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি আচরণ চিন্তা করে অনেকেই বলছেন, এই বৈঠকে ইরানের প্রতি সমর্থনের জন্য মুনিরকে সতর্কবার্তাও দিতে পারেন তিনি। কারণ পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরান আক্রমণকে “সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন” এবং “অন্যায় ও অবৈধ আগ্রাসন” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফসহ অনেক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা প্রকাশ্যে ইরানের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। খাজা আসিফ মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন এবং ওআইসি’র জরুরি বৈঠক ডাকার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ভবিষ্যতে অঞ্চলজুড়ে সংঘর্ষ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আসিফ। তবে তিনি ইরানি জেনারেল মহসেন রেজায়ির সেই দাবি অস্বীকার করেছেন, যেখানে বলা হয়েছিল— ইসরায়েল যদি ইরানে পারমাণবিক হামলা চালায়, তবে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিশোধ নেবে। খাজা আসিফ একে “ভুয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ইরানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যতটা সক্রিয়, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির সময় ততটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। পাকিস্তান নিজেই একসময় উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করেছিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির বিনিময়ে। এছাড়া, বিতর্কিত বিজ্ঞানী এ কিউ খান গোপনে ইরানকেও সহায়তা করার চেষ্টা করেছিলেন।
জেনারেল মুনির ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কট্টরপন্থী হলেও, প্রবাসী পাকিস্তানিরা যারা ইমরান খানের পিটিআই’র ঘনিষ্ঠ, তারা তাকে “ইসরায়েলপন্থী” বলে অভিযোগ করছেন। তাদের মতে, মুনির ওয়াশিংটনে ইসরায়েলপন্থী লবিগ্রুপ AIPAC-এর এক সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং এই সফরের আয়োজন করেছেন তার ঘনিষ্ঠ যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সহচর সাজিদ তারার।
সাজিদ তারার একজন পাকিস্তানি-মার্কিন ব্যবসায়ী, যিনি মেরিল্যান্ড-ভিত্তিক এবং দীর্ঘদিন ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি “American Muslims for Trump” সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। রিপাবলিকান জাতীয় কনভেনশনে পরপর তিনবার বক্তৃতা দিয়েছেন এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার ছেলেও স্টেট ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছেন।
তারার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করেছেন এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে কথা বলেছেন বহুবার।
পিটিআই সমর্থকদের দাবি, ট্রাম্প-মুনির মধ্যাহ্নভোজের এই অনুষ্ঠানের পিছনে মূল ভূমিকা ছিল সাজিদ তারারের। তিনি ফোর সিজন হোটেলে মুনিরকে সংবর্ধনাও দিয়েছেন, যেখানে তিনি প্রবাসী পাকিস্তানিদের “সত্যিকারের রাষ্ট্রদূত” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদিও এইসব প্রশংসার মাঝেও তিনি একবারও উচ্চারণ করেননি, কতজন প্রবাসী পাকিস্তানি যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত।
কেএন/টিকে