৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১২টায় জানতে পারি হাসিনার পতন হবে : চৌধুরী মামুন

জুলাই আন্দোলন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় এ বছরের ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি। ৫ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে ২০১৮-এর ভোটে অনিয়ম, গুম, খুন ও জুলাই আন্দোলন নিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান।

জবানবন্দিতে ৪ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাদের বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন বাহিনীর প্রধান, আমিসহ নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন নিয়ে এবং তা দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সংস্কারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিং থাকাবস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।

তিনি আরও বলেন, ৪ আগস্ট রাতে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। গণভবনে রাত ১০টার দিকে বৈঠক হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তার বোন শেখ রেহানা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, আমিসহ র‍্যাব ডিজি উপস্থিত ছিলাম। এসবি প্রধান মনিরুল বাইরে বসা ছিলেন। জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। খোলামেলা কথা হয়। কীভাবে ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয়। ফোর্স মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

এই বৈঠক প্রায় ৩০-৪৫ মিনিট হয়। বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, ডিজি র‍্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২ টায় শেষ হয়।

বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশ মুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। পুলিশ সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয় করে কাজ করবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। 

শেখ হাসিনার পতনের দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, পরদিন ৫ আগস্ট বেলা ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের পুলিশ শক্ত অবস্থান ছিল। ঢাকার প্রবেশ মুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ি এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অবস্থান নেই। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসাররা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা প্রদান করেন। বেলা ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লক্ষ লক্ষ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি যে, সেনাবাহিনী বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এর ফলে জনগণের গণভবনমুখি স্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি। দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। 

পিএমও থেকে আমাদেরকে বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। আমি ৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২ থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি যে, সরকার পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারত যাবেন কিনা, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।

সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়ার বর্ণনা দিয়ে মামুন বলেন, আমি বিকেলে জানতে পারি পুলিশ অফিসারদের নেওয়ার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হেলিকপ্টার আসবে। আমি এ হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই এবং সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে আশ্রয় গ্রহণ করি।

জবানবন্দিতে নিজে অনুতপ্ত জানিয়ে তিনি বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বিচারে নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

ইউটি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হেফাজত আমিরের বক্তব্যে জামায়াতের প্রতিবাদ Sep 15, 2025
img
ঢাকা বিভাগের কাউন্সিলরশিপ গ্রহণ করলেন বুলবুল Sep 15, 2025
img
সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৫৬১ Sep 15, 2025
img
শুধু উচ্চকক্ষের জন্য পিআর পদ্ধতি চাইছে এনসিপি: জাভেদ রাসিন Sep 15, 2025
img
টানা ৫ দিন ভারি বৃষ্টির আভাস Sep 15, 2025
img
মাত্র ১৩ বছরেই শতকোটি টাকার মালিক আরাধ্যা বচ্চন Sep 15, 2025
img
সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের ফ্ল্যাট-জমি জব্দ, অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাব Sep 15, 2025
img
আবুধাবিতে ওমানকে ১৭৩ রানের লক্ষ্য দিল আমিরাত Sep 15, 2025
img
বাগদান সারলেন হুমা কুরেশি! Sep 15, 2025
img
জাকসু নির্বাচনে কারসাজি, এক দলকে জিতিয়ে আনতে সব মনোযোগ ছিল: শিক্ষক নেটওয়ার্ক Sep 15, 2025
img
নেটফ্লিক্স, থ্রিলার ও মহাকাব্যিক ছবিতে সানি দেওলের ব্যস্ত সময় Sep 15, 2025
img
বেনেটের সেঞ্চুরি মিসেও জিম্বাবুয়ের বড় জয় Sep 15, 2025
img
পিআর একটি সুপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান : রিজভী Sep 15, 2025
img
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংস্কার সম্পন্ন জরুরি: ইইউ রাষ্ট্রদূত Sep 15, 2025
img
এনসিপির সংগঠক শিরীনকে সাময়িক অব্যাহতি Sep 15, 2025
img
নির্বাচন যারা বানচাল করার চেষ্টা করছে তারা সচিবালয়ে অবস্থান করছে: ফারুক Sep 15, 2025
img
চ্যাম্পিয়ন হয়েও মূল পর্বে খেলছে না ঋতুপর্ণা-মনিকাদের রাঙামাটি Sep 15, 2025
img
সেমন্তী সৌমির পছন্দ দেশি ছেলে! Sep 15, 2025
img
চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করতে হবে : চসিক মেয়র Sep 15, 2025
img
রাজপথ নয়, এখন সময় জনগণের মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার : আমীর খসরু Sep 15, 2025