‘ওরা ১১ জন’ ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি। এটি ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত, স্বাধীন বাংলার প্রথম ছায়াছবি। পূর্ণদৈর্ঘ্য এই ছায়াছবিটি পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। প্রযোজনায় ছিলেন মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)।
সিনেমার নামের মতোই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা দৃশ্যে নানা রূপকের ব্যবহার কুশলতার সঙ্গেই ঘটিয়েছেন পরিচালক। ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে ১১ দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল, আর ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। তাই ছবির শুরুতেই যখন ‘ওরা ১১ জন’ নামটি পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন কামানের ছয়টি গোলা ছোড়া হয়। পরিচালকের ভাষ্যে, ওগুলো ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ছয় দফার প্রতীক।
‘ওরা ১১ জন’-এর শুরু হয় সাইফুল ইসলামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ দিয়ে। আর শেষ হয় সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দিয়ে। দেশপ্রেম থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের গাঁথাই যেন গান দুটি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন নির্মাতা।
এ ছায়াছবিতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অভিনয় করেন- খসরু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মঞ্জু, হেলাল, ওলীন, আবু, আতা, বেবী, মুরাদ, নান্টু ও আলতাফ। এই ১১ অভিনয় শিল্পীর সবাই ছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।
শেষের জন বাদে এদের কারোরই ছিল না অভিনয়ের কোনো প্রশিক্ষণ। তারপরও কিছু দৃশ্যে সংলাপের জড়তা ছাড়া, সিনেমার নব্বই শতাংশেই এঁদের দৃঢ় উপস্থিতি আন্দোলিত করে দর্শকদের।
সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা। ‘ওরা ১১ জন’-এর পুরোটা জুড়েই পুরুষের পাশাপাশি রণাঙ্গনে নারীর ভূমিকাকে দেখানো হয়েছে সমানভাবে।
সিনেমার অন্যতম চরিত্র, মুক্তিযোদ্ধা খসরুর বোন, মেডিকেল ছাত্রী মিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাবানা; যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিগৃহীত হতে হয় তাকে। ধর্ষণের গ্লানি বয়েও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাতেই তিনি নিয়োজিত থাকেন।
ওই একই গ্রামে বাস করে কেয়া। খসরুর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় সে। অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়া যখন জানতে পারে তার নিজের বাবাই গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, তখন চোখে জল এলেও বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না সে। পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু হলে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মেশিনগান চালায়।
সেবিকা, যোদ্ধা- এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি নিপীড়িতা, নিগৃহিতার চরিত্রেও নারীকে দেখিয়েছেন পরিচালক। খসরুর বাগদত্তা শীলাকে (নূতন) যেমন দেখা যায়, যুদ্ধ শেষে বন্দীশিবির থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় খসরুর কোলে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করতে। স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের ইতিহাসই যেন এক নিমেষে উঠে আসে দৃশ্যটির মাধ্যমে।
সেই সঙ্গে বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়ার বিষয়টিও ছায়াছবির শেষের অংশে তুলে ধরেছেন নির্মাতা। দীর্ঘদিন পাকিস্তানিদের অত্যাচার সওয়া পারভেজ ফিরে এসে যখন জানতে পারে, তার প্রেমিকা মিতার সম্ভ্রমহানির কথা, তখন ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে প্রেয়সীকে বুকে টেনে নেয় সে। পারভেজের চরিত্রে সিনেমাটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা নায়করাজ রাজ্জাকের অভিনয় ছিল এককথায় অনবদ্য।
রাজ্জাক, শাবানার পাশাপাশি পার্শ্ব-চরিত্রগুলোতে নিজেদের কুশলতার পরিচয় রেখেছেন আলতাফ, হাসান ইমাম, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, মিনারা জামান, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো অভিনয়শিল্পীরা। বিশেষ করে সন্তানকে একবার দেখবার আশায় পথ চেয়ে থাকা গেরিলার চরিত্রে আলতাফ, যুদ্ধে নিজের বড় ছেলেকে হারিয়ে ছোট ছেলেকেও মুক্তিবাহিনীর হাতে সঁপে দেয়া মায়ের চরিত্রে রওশন জামিল আর ধূর্ত, স্বার্থান্বেষী কিন্তু একইসঙ্গে কাপুরুষ রাজাকারের চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের অভিনয় মনে রাখার মতো।
টাইমস/জিএস