স্বপ্ন পূরণের পথে রিয়া

সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় হাসিখুশি ভরা নম্র-ভদ্র, সাহসী, সৎ ও মেধাবী একটি শিশুর নাম ‘রিয়া’। দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার জঙ্গলবাড়ি ইউনিয়নের জঙ্গল নামক গ্রামে। সময়ের প্রয়োজনে আরেকটু ভাল থাকার বাসনা নিয়ে রিয়ার বাবা-মা ১৯৯৫ সালে পাড়ি জমায় ঢাকা শহরের আজিমপুর এলাকায়। একটি হোটেলে চাকরি নেয় রিয়ার বাবা রুহুল আমিন। একই হোটেলে রাঁধুনির কাজ করতো রিয়ার মা। এক সময় রিয়ার বাবা নিজেই হোটেল ব্যবসা শুরু করেন ঢাকার আজিমপুর, গুলিস্তান ও সর্বশেষে কচুক্ষেত এলাকায়। ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করে এবং সফলতার দিকে ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। সুখেই দিন কাটছিল এই ছোট্ট পরিবারের।

মা-বাবা আর দুই বোনের একটি হাস্যজ্জ্বল সুখী পরিবার ছিল রিয়ার। রিয়ার বাবা মেয়েদের আদর করতো আর বলতো এটা আমার জোড়া লক্ষ্মীর সংসার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস হঠাৎ করেই রিয়ার বাবা ২০১৩ সালে হার্টস্ট্রোক করে পরপারে চলে যান। রিয়ার মা ছোট্ট দু’টি নিষ্পাপ শিশুকে নিয়ে যেন অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলেন। একটা সময় হোটেল ব্যবসা আর টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। হোটেলের পজিশন বিক্রি করে দিলেন আড়াই লাখ টাকায়। কিন্তু নিয়তি যখন মুখ ফিরিয়ে নেন তখন নিষ্ঠুর পৃথিবীর আপন মানুষগুলোও ঠকাতে দ্বিধা করে না। রিয়ার চাচা ও দাদী রিয়ার পরিবারকে নিঃস্ব করে আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এখন কিভাবে এই ছোট্ট সোনামনিদের মুখে আহার তুলে দিবে, তাদের মুখে হাসি ফুটাবে, একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ আগামীর স্বপ্ন দেখাবে এই দুঃস্বপ্নে বিভোর রিয়ার মা।

রিয়ার বয়স তখন ৩ বছর আর রিয়ার ছোট্ট বোন সবেমাত্র ১ বছরে পদার্পণ করেছে। তাদের নিয়ে খিলগাঁও এলাকায় ৭৪ নং ওয়ার্ড, ১ নং রোডের ১৮ নং বাড়িতে ২৫০০ টাকা ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। টয়লেট বাথরুম সুবিধাবিহীন বাসায় ভাড়া থাকেন। শিশুরা নির্ধারিত পটে মল ত্যাগ করতো আর রাতে রিয়ার মা মল বাইরে ফেলে আসতো। তাদের থাকার পরিবেশটা ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। শোককে চাপা দিয়ে বুকে পাথর বেঁধে মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেয় রিয়ার মা জরিনা বিবি। ছোট্ট সোনামনিদের ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। এছাড়াও অন কলে মাছ কাটা, বাথরুম পরিষ্কার, ফ্রিজ পরিষ্কার, জানালা পরিষ্কার, ঘর মুছাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। এভাবেই তিনি সন্তানের মঙ্গলের জন্য সব ধরনের কাজ করতেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, যেসব বাড়িতে তিনি গৃহ কর্মীর কাজ করতেন সেখান থেকে তিনি মাঝে মাঝে চুরি করতেও দ্বিধা করেননি।

এভাবেই সে কষ্ট করে বার হাজার টাকা জমা করেন তিনি। আর যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়িওয়ালার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে বেবী আক্তার (১৯) রিয়ার মাকে আট হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। সেই টাকা দিয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি চা-পানের দোকান শুরু করেন রিয়ার মা।

সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এভাবে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন থেকে কেটে গেছে ৬ বছর। দেখতে দেখতে রিয়া আর রিপা দুই বোন বড় হয়ে গেছে। রিয়ার বয়স ৯। রিয়ার মা রিয়াকে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানে ৩০০ টাকা বেতনসহ আরো অন্যান্য খরচ বহন করা, অভাবের টানাপোড়েন সংসারে সব কিছু মেইনটেইন করা যেন তার জন্য একটি নিত্যদিনের যুদ্ধ। তাই সব কিছু মেইনটেইন আর দোকানে সময় দেয়া ইত্যাদি কারণে রিয়া পড়ালেখা থেকে ঝরেপড়ে। রিয়া ফুল টাইম চায়ের দোকানে তার মাকে সময় দিতে থাকে। কিন্তু রিয়ার মনে বাসনা সে পড়া লেখা করবে। কিন্তু নির্মম নিয়তিতে অনেকের সাধ আছে, সাধ্য নাই। ঠিক এমন সময় আশীর্বাদ স্বরূপ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক শিখন কেন্দ্র ভেলিডেশন/ হালনাগাদ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন রিয়ার মা জানতে পারেন আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রের কথা। জানতে পারে সেখানে বিনামূল্যে সুবিধামত সময়ে পড়ালেখা করানো হয়। এ কথা শোনার পর রিয়ার চোখে মুখে হাসি ঝলমল করে উঠে। নন্দীপাড়া আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্রে দ্বিতীয় শ্রেণি/সবুজ দলে তার নাম অন্তর্ভুক্তি করা হলো। রিয়া এখানে সকাল শিফটে পড়ালেখা করে আর বিকালে তার মাকে দোকানের কাজে সাহায্য করে। দোকানের হিসাব নিকাশ রাখে। এত অল্প বয়সেও সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খেয়ে রিয়া দায়িত্ব নিতে শিখেছে। রিয়ার দূরদর্শিতা ও সাহসিকতায় তার মায়ের ব্যবসা সফলতার মুখ দেখছে। তারা এখন দুবেলা দু’মুঠো ডাল ভাত খেতে পারে।

রিয়া এখন ১০ বছরে পা রেখেছে। পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। পড়া-লেখায় রিয়া খুবই মেধাবী। এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও সে হাসিখুশি থাকে। সে এখন সব কিছু বুঝতে শিখেছে। তার মায়ের কষ্টের স্মৃতি তার বুকে কাটার মতো বিধে আছে। সে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে সারাজীবন তার মায়ের পাশে থেকে সাহায্য করতে চায়। সে বড় হয়ে পুলিশ হতে চায় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। আত্মবিশ্বাসী রিয়া এখন ধীরে ধীরে তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সে সকল মানুষকে বুঝিয়ে দিতে চায় অভাব কখনো বড় হওয়ার পথে বাধা নয়, বরং অভাব বড় হতে শেখায়।

রিয়ার মা বলেন, “আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত স্মৃতি আমি কোনদিন ভুলে যেতে চাই না। এই অতীতের অন্ধকার স্মৃতিই যেন আমার জীবনের পুঁজি। আমি আমার মেয়ে দুটোকে শিক্ষিত, ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আর এই কাজে সহযোগিতার জন্য জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়; সহযোগী সংস্থা- সাতক্ষিরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) ও এসোসিয়েশন ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক (এডিএস) কে সাথে নিয়ে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া, কখনো স্কুলে পড়েনি এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা, সিলেট ও গাইবান্ধা জেলায় ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীকে ১ হাজার শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে এবিএএল পদ্ধতির পাঠদান দিয়ে আসছে। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার হার কমানোসহ মেয়েরা যাতে সমমর্যাদা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

উত্তরখান ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ও সেন্টার ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতির মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘‘রিয়ার মতো যে সব শিশু খুব কণ্টকাকীর্ণ পরিবেশে ঘাত-প্রতিঘাত খেয়ে বড় হয়েছেন তাদের জীবনটা ফুলের মতো ভরিয়ে দিতে সরকার ও এনজিও’দের সাথে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।’’

শেষ কথা: জীবনে চলার পথে শত বাধা বিপত্তি মানুষের জীবনে একটি বড় অন্তরায়। তবুও থেমে থাকা যাবে না, এগিয়ে যেতে হবে গন্তব্যের অনুকূলে, অজানা পথে খুঁজতে হবে আশার আলো, হয়তো একদিন অজানা আলো আলোকিত করবে আমার পথকে।

লেখকদ্বয়: বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।

 

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচন : আজ মাঠে নামবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী May 19, 2024
img
বেরিয়ে এলো জুজুৎসুর নিউটনের ‘ভয়ংকর’ যৌন নিপীড়নের তথ্য May 19, 2024
img
চেন্নাইকে বিদায় করে টানা ছয় ম্যাচ জিতে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু May 19, 2024
img
রাসায়নিক খাতের উন্নয়নে দেশেই কারখানা তৈরি করতে চান ব্যবসায়ীরা May 19, 2024
img
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দেখে বিএনপির মাথা খারাপ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী May 18, 2024
img
কেন্দ্র দখলতো দূরের কথা, একটি জাল ভোট পড়লেও কেন্দ্র বন্ধ : ইসি হাবিব May 18, 2024
img
আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম May 18, 2024
img
ইন্টারনেট ব্যবহারে এশিয়ায় বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশের নারীরা May 18, 2024
img
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা নেই : খুরশিদ আলম May 18, 2024
img
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকরা কেন ঢুকবেন, প্রশ্ন ওবায়দুল কাদেরের May 18, 2024